চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

জানুয়ারিতে বড় পর্দায় আসছে ‘চন্দ্রাবতী কথা’

বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি বলা হয় চন্দ্রাবতীকে। মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা এবং রামায়ণ তার অন্যতম সৃষ্টি। তবে তার সৃষ্টির চেয়ে ঢের বেশি নাটকীয় এবং একইসঙ্গে বিয়োগান্তক তার নিজের জীবন। ষোড়শ শতকের অসম্ভব প্রতিভাবান ও সংগ্রামী এই নারীকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। আর এটি নির্মাণ করেছেন এন রাশেদ চৌধুরী। ছবিটি মুক্তি পেতে যাচ্ছে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে!

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়েছিলো ‘চন্দ্রাবতী কথা’র শুটিং। এরপর কেটে গেছে প্রায় চার বছর। দীর্ঘদিন ধরেই ছবিটির জন্য অপেক্ষায় আছে দর্শক। এবার নির্মাতা জানালেন, ‘অপেক্ষার প্রহর ফুরালো। আসছে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই দেশব্যাপী মুক্তি পেতে যাচ্ছে ‘চন্দ্রাবতী কথা’।’

কিন্তু একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে এই দীর্ঘ যাত্রার কারণ কী?-এমন প্রশ্নের উত্তরে নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরী বলেন, ‘চন্দ্রাবতী কথা’ একটি বড় সিনেমা, তারউপর পিরিয়ডিক্যাল! ষোল শতকের একটি গল্প ‘চন্দ্রাবতী কথা’। এতো পুরনো সময়ের কনটেক্সট যে, আমরা যখন কাজে নামলাম তখন বহু বিষয় ভাবতে হয়েছে। চন্দ্রাবতীর বাড়ি যেহেতু কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে ছিলো, এবং সেটা হাওর অঞ্চল। তাই আমরা যখন গল্পটা দেখাচ্ছি তখন আমাদের হাওরের ঋতু সম্পর্কেও ধারণা নিতে হয়েছে। প্রতিটা সিজনে কিন্তু হাওরের রূপ বদল হয়। এগুলো নিয়ে স্টাডি করতে হয়েছে। তো এইরকম অনেক বিষয়ের প্রতি সৎ থাকতে চেয়েছি। ফলে বিভিন্ন ঋতুতে আমরা শুট করেছি। আমরা আন্তরিক ভাবেই চেয়েছি যে, গল্প যা ডিমান্ড করে সেটা পূর্ণাঙ্গভাবে সিনেমায় তুলে ধরতে! আর এসব কারণেই আমাদের প্রায় বছর দুয়েক লেগেছে শুধু শুট করতেই।

সিনেমাটি চন্দ্রাবতীর সারাজীবনের একটি গল্প, তাই এর পরিধিও বড়। চন্দ্রাবতীর জীবন দেখানোর সাথে সাথে সিনেমায় ওই সময়ের সামাজিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপট, ঘটনা এবং পারফর্মেন্স স্টাইলও উঠে এসেছে বলে  জানান নির্মাতা। এ বিষয়ে তিনি বলেন: ছবিটা চন্দ্রাবতীর জীবনী নির্ভর হলেও সমসাময়িক সহজিয়া সমাজ জীবন ও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মিথস্ক্রিয়া এছবির অন্যতম অনুষঙ্গ। ছবিতে পূর্ববঙ্গের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী অভিনয় রীতি সমূহের নানা ফর্ম কেও ট্রিবিউট করার প্রচেষ্টা রয়েছে।

চন্দ্রাবতীর জন্মস্থান কিশোরগঞ্জে রিয়েল লোকেশনেই ছবির পুরো শুট করা হয়েছে। ছবিতে গ্রামের সাধারণ মানুষেরাও অভিনয় করেছেন বলে জানান রাশেদ চৌধুরী। বিশেষ করে পালাকার বা বয়াতি-এরকম চরিত্রগুলোতে সেখানকার গ্রামের মানুষই অভিনয় করেছেন।

পিরিয়ডিক্যাল সিনেমা হওয়ায় সব সময় সতর্ক থাকতে হয়েছে জানিয়ে নির্মাতা আরো বলেন: আমাদের বহু সতর্ক থেকে কাজটি করতে হয়েছে। যেহেতু আমরা প্রায় চারশো বছর আগের কাহিনী দেখাচ্ছি, আগের প্রেক্ষাপট দেখাচ্ছি তাই আমরা যখন শুট করি তখন সেই সময়ের বাস্তবতাগুলো সব সময় মাথায় রাখতে হয়েছে। এমনকি একটি পলিথিন ব্যাগ, বা টিনের চাল কিংবা ইউক্যালিপটাস গাছ যদি ফ্রেমে চলে আসে তাহলেতো দর্শক ছবিটিকে প্রথমেই খারিজ করে দেবে, বিশ্বাসযোগ্যতাটাই নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে বিষয়বস্তু ও সময়ের প্রতি সচেতন থাকতে হয়েছে। 

সিনেমার পরিবেশন নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করছেন কিনা জানতে চাইলে রাশেদ চৌধুরী বলেন: আমাদের ছবিটা যেহেতু ডিজিটাল ফরম্যাটে (ডিসিপি করা)। ফলে আমরা চেষ্টা করবো ঢাকার যে সব হলগুলোতে ডিসিপি করা, সেখানে ছবিটি মুক্তি দিতে। ঢাকার মধ্যে বিশেষ করে স্টার সিনেপ্লেক্স, যমুনা ব্লকবাস্টার, শ্যামলী সিনেমা হল ও বলাকায় ছবিটি মুক্তি দিতে চাই। এরপর বিভাগীয় শহরগুলোও আমাদের টার্গেট। এছাড়া ময়মনসিংহ অঞ্চলেও ছবিটি মুক্তি দিতে চাই। যেহেতু সেই এলাকার গল্প এটি এবং সেই এলাকার ভাষায় নির্মিত এটি।

‘চন্দ্রাবতী’ কথার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন দোয়েল ম্যাশ। ছবি: রাওয়ান সায়েমা

এরপর বিকল্প ব্যবস্থায় দেশের বিভিন্ন জেলা শহর, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ছবিটি নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ পোষণ করেন নির্মাতা।

নব্বই দশকের আগে থেকেই স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছেন এন রাশেদ চৌধুরী। স্কুল জীবন শেষ করার পরই ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্টের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হন। ১৯৮৯ সাল থেকে আছেন বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরামের সঙ্গে। সিনেমা দেখা, সিনেমার বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নেয়ার পর থেকেই সিনেমা নির্মাণের প্রতি ঝোঁক তৈরী হয় রাশেদ চৌধুরীর। তার কথায়, জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র ‘নহন্যতে (দি লং ওয়েট)’ নির্মাণ করি নভেরা আহমেদকে নিয়ে। এটি ছিলো একটি প্রামাণ্যচিত্র। ১৯৯৯ সালে শেষ হওয়া ছবিটার দৈর্ঘ্য ছিলো প্রায় এক ঘন্টার মতোন। এটি পরে চ্যানেল আইতেও দেখানো হয়। এরপর ২০০৩ সালে নির্মাণ করি ‘বিস্মরণের নদী’ নামে আরেকটি শর্টফিকশন। এটি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রদর্শীত হয়। বিশেষ করে ফ্রান্স, ভারতসহ কমনওয়েলথ চলচ্চিত্র উৎসবেও তৎকালীন সময়ে ছটি দেখানো হয়।

শুটিংস্পটে নির্মাতা এন রাশেদ। ছবি: রাওয়ান সায়েমা

রাশেদ চৌধুরী বলেন: নভেরা আহমেদকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নহন্যতে (দি লং ওয়েট) এবং ‘বিস্মরণের নদী’ নামের দুটি ছবি নির্মাণের পরেই পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করি। কিন্তু সেসময় যখন আমরা কেবল ১৬ মিলিমিটারে ফিল্ম করছি, এরমাঝখানে আবার ফিল্ম ফরম্যাটটা চেঞ্জ হয়ে ভিডিও ফরম্যাটে কনভার্ট হয়ে গেলো। সে কারণে দুইটা মিডিয়ামের গ্যাপে একটা স্থিতাবস্থা বিরাজ করে কয়েক বছর। আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে দুটোর মধ্যে আমরা কোন ফরম্যাটে কাজ করবো। তো আল্টিমেটলি দেখা গেলো ক্যামেরার ডেভেলপমেন্টের কারণে ফিল্ম ফরম্যাট ব্যাপারটা উঠেই গেলো প্রায়। তো এরমধ্যে ২০০৭-২০০৮ সালে আমি আরেকটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করি। স্পেন প্রবাসী বাংলাদেশি পেইন্টার শহীদ কবীরকে নিয়ে। যার নাম ‘উজানের যাত্রী’। আর এরপরেই মূলত ‘চন্দ্রাবতী কথা’য় হাত দেই।

সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ম্যানগ্রোভ পিকচারস ও বেঙ্গল ক্রিয়েসন্স-এর প্রযোজনায় ‘চন্দ্রাবতী কথা’র কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন মডেল ও অভিনেত্রী দোয়েল ম্যাশ। এছাড়া আরো অভিনয় করেছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মিতা রহমান, গাজী রাকায়েত, আরমান পারভেজ মুরাদ, নওশাবা আহমেদ, ইমতিয়াজ বর্ষণ, জয়িতা মহলানবিশ প্রমুখ।

ছবির সম্পাদনা ও শব্দ সংযোজনে ছিলেন যথাক্রমে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সম্পাদক শঙ্খ ও শব্দগ্রাহক সুকান্ত মজুমদার। এর কালার কারেকশন ও পোস্ট এর অন্যান্য কাজ হয়েছে কলকাতার চেরীপিক্স এ। ছবির সংগীতায়জনে ছিলেন কলকাতার খ্যাতনামা লোকংগীত শিল্পী সাত্যকি ব্যানার্জী। ‘চন্দ্রাবতী কথা’ সিনেমায় অনন্য এক বিচ্ছেদী ভাটিয়ালি গান গেয়েছেন স্থানীয় রামায়ণ-পালা শিল্পী শংকর।

ছবিটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে পরিবেশনার দায়িত্ব নিয়েছে দেশের উল্লেখযোগ্য শিল্পপণ্য প্রস্তুতকরন প্রতিষ্ঠান-বসুন্ধরা এল পি গ্যাস। ছবির টিভি ও অনলাইন সত্ব চ্যানেল আইয়ের।