নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন শান্তিপূর্নভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।বিজয়ী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনের বাসায় মিষ্টি নিয়ে গেলেন। পরাজিত প্রার্থী বিজয়ী প্রার্থীকে স্বাগত জানালেন ও আপ্যায়িত করলেন। গণতন্ত্র চর্চায় এগুলো খুবই প্রশংসনীয় দিক।
ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, ক্লিন ইমেজ ও সন্ত্রাসবিরোধী ভূমিকায় সক্রিয়তায় থাকা ব্যক্তির হাতে দলীয় মনোনয়ন ও নৌকা প্রতীক তুলে দেয়াতেই এই বিজয়। জয়লাভের পরে আইভী সাখাওয়াতকে বলেছেন, তিনি তার নির্বাচনী ইশতেহার দেখে জনকল্যানমুখী বিষয়গুলো অনুসরন করবেন ও সে অনুযায়ী কর্ম প্রক্রিয়া চালাবেন। পরাজিত প্রার্থীর বাসায় গিয়ে তার নির্বাচনী ইশতেহার খুঁজতে চাওয়া সত্যিই একটি বিরল ঘটনা।
বিগত দিনে আমরা দেখেছি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক প্রার্থী সমর্থকদের থানা হাজতে ভরে ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজেদের পক্ষে টানার প্রবণতা। রাজাকারের সন্তানদের দলীয় মনোনয়ন দেয়ার প্রবণতা। ক্ষমতা দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা। নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এসব দেখা যায়নি। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে এটিই সর্বশেষ নির্বাচন। শেষটি ভালই হল।
নাসিক নির্বাচনে প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মেরে এক বিতর্কের জন্ম দিলেন বিতর্কিত সাংসদ শামীম ওসমান। এটি কেন করলেন তিনি? নাকি প্রকাশ্যে না দিলে মানুষ বিশ্বাস করতো না যে তিনি আইভীকে ভোট দিয়েছেন?
তিনি বলেছেন, সাংবাদিকরা এরকম একটি ফুটেজই খুঁজছিলেন। কোন সাংবাদিক বললো, তারা এরকম একটি ফুটেজ খুঁজছিলেন? তিনি বলেছেন,আইভী পাশ করে তাকে আইসক্রিম খাওয়াচ্ছেন। এরকম অগুরুত্বপূর্ণ, চটকদার বক্তব্য দেয়ার উদ্দেশ্য কী।
তিনিতো একজন গুরুত্বহীন ব্যক্তি নন একজন আইনপ্রণেতা। অবশ্য তিনি ভোটে পাশ করেননি। করেছেন বিনাভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।কিন্তু আইভী গতবারও মেয়র হয়েছেন ভোটে ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এবারও তাই। এরকম আরও অনেক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়া ব্যক্তি রয়েছেন। তারা কেউ রয়েছেন, সংখ্যালঘু নির্যাতনে, কেউ আদিবাসী নির্যাতনে, কেউ সাংবাদিক পেটানোতে।
জনগণের সাথে অফলাইন, অনলাইন কোনধরনের সম্পৃক্ততাই নেই তাদের। নেই দল ও জোটের তৃণমূলের সাথে যোগাযোগ। অনেক জায়গায় বিএনপি জামাত হতে দলে দলে যোগদান করাচ্ছে সরকার দলে। যোগদান অনুষ্ঠানের ব্যানারে শোভা পাচ্ছে স্থানীয় সাংসদের ছবি। সেখানে ছিল না বঙ্গবন্ধুর ছবি ও শেখ হাসিনার ছবি। গণবিচ্ছিন্ন কতিপয় সাংসদ তাদের নানা কর্মকাণ্ডে প্রতিনিয়ত সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যার দায় চাপছে সরকার প্রধানের উপর।
দলীয় আনুগত্যহীনতা এমন চরম আত্মঘাতী হয়ে ওঠে যে নিজে মনোনয়ন না পেলে তারা অনেকেই প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে তার অনুসারীদের ভোট দিয়ে দিতে বলে। তাই প্রথাগতভাবেই শামীম ওসমান আইভীকে ভোট দেবে না এরকম সন্দেহ সংশয় ছিল হয়তো অনেকের। আইভীর একমাত্র পুঁজি ছিল জনপ্রিয়তা। ২০০৩ সালে চারদলীয় জোট শাসনামলে পৌর মেয়র নির্বাচিত হয়ে তিনি তাক লাগিয়ে দেন। এরপর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা সিটি করপোরেশন হলে আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থন প্রাপ্ত প্রার্থী শামীম ওসমানকে হারিয়ে জয়লাভ করেন তিনি। শামীম ওসমান এই পরাজয় না মানতে পেরে আইভীর নানা কর্মকাণ্ডে বিভিন্নভাবে বাধা দিয়েছেন। তাকে শান্ত রাখতে অনেক কেন্দ্রীয় নেতাকেও গলদ ঘর্ম হতে হয়েছে বলে শোনা যায়।
সকল বাধা অতিক্রম করে সেলিনা হায়াৎ আইভী পথ পাড়ি দিয়ে এবারের নির্বাচন পর্যন্ত আসেন। এবার প্রথম বাধা আসে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে। গত ১৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগ মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়ার জন্য তিনজনের নামের তালিকা কেন্দ্রে প্রেরণ করে। তিনজন হলেন, মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন, বন্দর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি এম এ রশীদ ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি মজিবর রহমান।
প্রার্থী হিসাবে দলীয় প্রস্তাবনায় আইভী ছিলেন না। গত ১৭ নভেম্বর রাতে সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রার্থীতা চেয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বরাবরে আবেদন করেন। নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ যে জনপ্রিয়তাবিহীন ভুল নেতাকে মনোনয়ন পাইয়ে দিতে চেয়েছিল সেটা পরিষ্কারভাবে প্রমানিত হল নির্বাচনী ফলাফলে। কেন তারা এই ভুলটা করতে চেয়েছিল? নিশ্চয়ই সেক্ষেত্রে দলের জয় পরাজয়ের ভাবনার চেয়ে নেতৃত্ব প্রবলভাবে কাজ করেছিল তাদের।
দলীয় সভানেত্রীর সিদ্ধান্তই দলকে একটি আত্মঘাতী ভুল হতে ফিরিয়ে আনল। এক্ষেত্রে ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনেও অনুরূপ ভুল মনোনয়নের ঘটনা যে ঘটতে চলেছে সেটা নিশ্চিত। দলীয় নেতাদের এই ভুল গুলো ঠেকাতে হবে দলীয় সভানেত্রীকেই। তৃণমূল ভোটিংয়েও পেশি শক্তি, অনিয়ম, জালিয়াতি হয়ে থাকে। নিজেদের কতৃত্ব, নেতৃত্ব ধরে রাখার জন্য তারা নানা প্রক্রিয়ায় নেত্রীকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করবে। যেমনটি নারায়ণগঞ্জের নেতারা করতে চেয়েছে।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়া জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে সতত সজাগ থাকতে হবে। এত সহজে, বিনাশ্রমে ও বিনা খরচে নির্বাচনী বৈতরনী পাড় হওয়া যায়। ব্যাপারটা খুবই লোভনীয়ই বটে! তাই আগামী নির্বাচনে অনেকেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে নানা কৌশলে নির্বাচনী প্রার্থীতা হতে সরিয়ে দিতে চেয়ে নিজের বিজয় নিশ্চিত করতে চাইবে। এগুলো রুখতে হবে। বিতর্কিত ও গণবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিরা যাতে মনোনয়ন না পেতে পারে নারায়ণগঞ্জের সিটি নির্বাচন গোটা জাতিকে সে শিক্ষাই দিয়ে গেল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)