চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য চিরস্থায়ী কলঙ্ক’

রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের জীবন রক্ষায় সামরিক এবং গোয়েন্দা ব্যর্থতাকে সেনাবাহিনীর জন্য চিরস্থায়ী কলংক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারক কাজী গোলাম রসুল। ‘আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য এটি একটি চিরস্থায়ী কলংক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে,’ বলে রায়ে মন্তব্য করেন ঢাকা জেলা এবং দায়রা জজ আদালত।

নাজিমউদ্দিন রোডে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে বিশেষ এজলাসে এক বছরের মতো সময় ধরে চলে ওই বিচার। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল। রায়টি এখন ঐতিহাসিক এক দলিল।

যেহেতু বিশাল রায়, বিচারক তাই এজলাসে পুরো রায় না পড়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড আর চারজনকে বেকসুর খালাস দেয়ার মূল আদেশটি পড়ে শুনিয়েছিলেন। তবে গুরুত্ব বিবেচনায় রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণও পাঠ করেছিলেন বিচারক।

সেই পর্যবেক্ষণে তিনি সুস্পষ্টভাবে সেনা কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা এবং রহস্যজনক আচরণের সমালোচনা করেছেন।

ডেথ রেফারেন্সের পেপার বুকের দলিল ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, রায়ের একেবারে শেষদিকে এসে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে বিচারক কাজী গোলাম রসুল লিখেছেন (সাধু থেকে চলিত ভাষায়): প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ না করে করে পারা যায় না যে, এই মামলায় প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিশেষ করে যারা ঢাকায় অবস্থান করছিলেন, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেননি, এমনকি পালনের কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করেননি।

সঙ্গে বিচারক একথাও বলেছেন ‘যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও,’ তারা দায়িত্ব পালন করেননি।

বিচারক লিখেছেন: অত্যন্ত দু:খের বিষয় যে, বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন আদেশ পাওয়ার পরও তার নিরাপত্তার জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সাক্ষ্য প্রমাণে পরিষ্কার যে, মাত্র দুটি রেজিমেন্টের খুবই অল্প সংখ্যক জুনিয়র সেনা অফিসার/সদস্য এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেনো এই কিছু সেনা সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ/নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেনি তা বোধগম্য নয়।

‘এটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য একটি চিরস্থায়ী কলংক হিসেকে চিহ্নিত হয়ে থাকবে,’ বলে তিনি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

খুনি কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা হলেও, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষীদের সাক্ষ্যের লাইনে লাইনে ফুটে উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক সেই ব্যর্থতার কথা।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মূল অভিযুক্ত ছিলো ২৪ জন। তাদের মধ্যে খন্দকার মুশতাক, মাহবুবুল আলম চাষী, ক্যাপ্টেন মোস্তফা এবং রিসালদার সারোয়ার ৯৬ সালে মামলার কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই মারা যাওয়ায় তাদেরকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি।

অন্য যে ২০ জনকে অভিযুক্ত করা হয় তাদের মধ্যে মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদের স্ত্রী জোবায়দা রশিদ উচ্চ আদালতে রিভিশন মামলায় অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় বিচার হয় ১৯ জনের বিরুদ্ধে।

তাদের মধ্যে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, অনারারি ক্যাপ্টেন আব্দুল ওয়াহাব জোয়ার্দার, দফাদার মারফত আলী এবং এল.ডি আবুল হাশেম মৃধাকে খালাস দেন বিচারিক আদালত।

কাঠগড়ায় থাকা মেজর ফারুক, মেজর শাহরিয়ার এবং আর্টিলারির কর্নেল মুহিউদ্দিনসহ ১৫ জনকে দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। এই তিনজনসহ পলাতক ১২ জনের মধ্যে ল্যান্সারের মেজর মহিউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদাকে দেশে ফিরিয়ে এনে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এদের মধ্যে বজলুল হুদাকে রায় ঘোষণার দিনই ব্যাংকক থেকে আনা হয়। মেজর মহিউদ্দিনকে ফেরত আনা হয় ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক আমলে।

এর বাইরে বিচারিক আদালতের মতো উচ্চ আদালতেও মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, মেজর রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মাজেদ এবং রিসালদার মোসলেহউদ্দিন বিদেশে পালিয়ে আছে। পলাতক অবস্থায় মারা গেছে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মেজর আজিজ পাশা। আর বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পেলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছে মেজর আহম্মেদ শরফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম এবং ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার।

অর্থাৎ, চূড়ান্ত বিচারে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১২ জনের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও এখনও পালিয়ে আছে ছয়জন।

অপরাধের ধরণে হাইকোর্টের অনুমোদন সাপেক্ষে ১৫ জনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যেকরের আদেশ দিয়েছিলেন বিচারিক আদালত। তবে রায়ে একথাও বলা হয়েছিলো, নির্দেশ অনুযায়ী ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে কর্তৃপক্ষের কোনো অসুবিধা থাকলে প্রচলিত নিয়ম অনুসারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেয়া হলো।

রায়ের পর্যবেক্ষণে সেদিন আদালত একথাও বলেছিলেন, ঘটনার পর কোনো কোনো আসামী দেশে-বিদেশে আত্মস্বীকৃত খুনি হিসেবে পরিচয় দিয়ে দাম্ভিকতা প্রকাশ করে। ‘ঘটনাটি কেবল নৃশংসই নয়, এই ঘটনায় দু’জন সদ্যবিবাহিতা বধূকে ও ১০ বছরের একজন শিশুকেও নির্মমভাবে গুলিতে হত্যা করা হয়।’

‘আসামীদের এই অপরাধ এমন একটি ক্ষতির কাজ যা শুধু ব্যক্তিবিশেষের জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষেও মারাত্মক ক্ষতি। দেখা যায় যে, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ পরিণতির বিষয় সজ্ঞানে জ্ঞাত থেকে ষড়যন্ত্রটি পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। সুতরাং তাদের প্রতি কোনো প্রকার সহানুভূতি ও অনুকম্পা প্রদর্শনের সুযোগ নেই,’ চূড়ান্ত শাস্তি ঘোষণার আগে এভাবেই তার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন আদালত।

জাতির জনক হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে এবং পরে খুনিদের বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ব্যর্থতার পাশাপাশি রাজনৈতিক সুবিধাবাদের দিকটিও রায়ে তুলে ধরেছিলেন বিচারপতি কাজী গোলাম রসুল।

ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: সকল সাক্ষ্য প্রমাণ পর্যালোচনায় ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ তারিখ বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে আসামি তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের জড়িত থাকা সম্পর্কে স্পষ্ট প্রমাণ বা সম্মতি নেই। কিন্তু ঘটনার পরপরই রেডিও স্টেশনে যাওয়াসহ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।

‘এখন প্রশ্ন হলো, এই বিজড়নের কারণে তাকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলা যায় কি না? এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা এই যে, অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগে ও পরে নেতার অনুসারীগণের ব্যবহারে অনেক পার্থক্য। এটা কিছুটা বোধগম্য, আমাদের দেশের নেতাভিত্তিক রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে যেমন- নেতা আছেন তো সব আছে, আমিও আছি, নেতা নাই তো কেউ নাই, আমিও নাই,’ উল্লেখ করে বিচারক বলেন, ঠাকুরের মতো বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠজনেরাও পরে মুশতাক মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন।

তবে ইতিহাস সাক্ষী শেষ পর্যন্ত জাতির জনক হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু মামলা দায়ের করে বিচার শুরু করতেই লেগে গিয়েছিলো দুই যুগ। এর কারণ খুনিদের দায়মুক্তি দেওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ।

বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করলে ওই বছরের নভেম্বর মাসে কুখ্যাত অধ্যাদেশটি বাতিল করা হয়। এর কয়েকদিন আগে ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম ধানমণ্ডি থানায় মামলা করেন। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচার শুরু হয় ১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ।

দেড়শ’কার্যদিবস শুনানির পর ১৯৯৮ সালে ৮ নভেম্বর ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এরপর হাইকোর্টে একের পর এক ঘটে বিব্রত হওয়ার ঘটনা। একাধিক বিচারপতি ডেথ রেফারেন্সের আপিল শুনানিতে বিব্রতবোধ করলে ২০০০ সালের জুন মাসে বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ও বিচারপতি মো. এবিএম খায়রুল হকের বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। মোট ৬৩ কার্যিদিবস শুনানির পর ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর এ মামলায় বিভক্ত রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশ বহাল রাখলেও ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ।

এরপর ২০০১ সালে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয় তৃতীয় বিচারপতি মো. ফজলুল করিমের আদালতে। তিনি ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১২ আসামির মধ্যে কারাবন্দি চারজন ‘লিভ টু আপিল’ দায়ের করে। কিন্তু এর মধ্যে সরকার পরিবর্তন হলে বিএনপি-জামায়াত আমলে নানা অজুহাতে শুনানি আর হয়নি। পরে ল্যান্সার মহিউদ্দিনকে ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত আনা হলে তার পক্ষেও ‘লিভ টু আপিল’ হয়। অর্ধযুগ পর ২০০৭ সালে শুরু হয় শুনানি। ২৫ কার্যদিবস শুনানির পর আসামিদের চূড়ান্ত আপিল শুনানি শুরুর অনুমতি দেন সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারপতির অভাবে শুনানি শুরু হতে আবারও সময় লাগে, পেরিয়ে যায় আরো অনেক মাস।

তবে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে জট খুলতে শুরু করে। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান আপিল বিভাগে ৪ জন বিচারপতিকে নিয়োগ দেন। এরপর ৫ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হয়ে চলে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত। এক সপ্তাহের মাথায় ১৯ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালত আসামিদের আপিল খারিজ করে দিলে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।

এরপর আসামিরা রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানায়। প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ ওই ‘রিভিউ পিটিশন’ও খারিজ করে দেন। একাধিক আসামি এর মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করলে তাও নাকচ হয়।

অবশেষে জাতির জনক হত্যার ৩৪ বছর পর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি কার্যকর হয় ফারুক, শাহরিয়ার, বজলুল হুদা, ল্যান্সারের মহিউদ্দিন এবং আর্টিলারির মুহিউদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড।
(১৪ পর্বের ধারাবাহিক শেষ)