যে নৃশংস পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ভূখণ্ডের উদ্ভব,
সেই পাক-হায়েনাদের দোসর, আলবদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির দড়িতে
ঝুলিয়ে ইতিহাসের গভীর ক্ষতচিহ্নে অনেকটাই প্রলেপ দিলো বাঙালি জাতি।
কোটি
কোটি মানুষের সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, উৎসর্গকে নির্মম তিরস্কার করে এই সেদিনই পূর্ণ মন্ত্রীত্বের অধিকারী নিজামীকে আজ তার সমুচিত প্রাপ্যটিই যেনো
স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়া হলো। মঙ্গলবার রাত ১২টা ১০ মিনিটে সৌম্য-শান্ত
চেহারার আড়ালে ধারণ করা কুৎসিত সেই পশুত্বের চরম দণ্ড কার্যকর হলো।
হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধই শুধু নয়, পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে স্বাধীন দেশটিকে মেধা ও নেতৃত্বশূন্য করতে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা প্রণয়নেও অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিলো আলবদর প্রধান ও তৎকালীন ইসলামি ছাত্রসংঘের সভাপতি নিজামীর। আপিল বিভাগের রায়ে তাকে একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নকশাকার বলে অভিহিত করা হয়।
২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে এক মামলায় নিজামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর একমাস পরে আগস্টের ২ তারিখে তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। প্রায় ৬ বছরের সুদীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে জাতির কলঙ্ক মোচনের সর্বশেষ ধাপও শেষ হলো আজ।
নিজামীর বিচারিক কার্যক্রম
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাবনায় হত্যা, ধর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবী গণহত্যার দায়ে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে আনা ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি প্রমাণিত হয় ট্রাইব্যুনালে। এরমধ্যে চারটিতে নিজামীকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে করা নিজামীর আপিলের আংশিক মঞ্জুর করে এ বছরের ৬ জানুয়ারি ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আপিলে আরও তিনটি অভিযোগ থেকে খালাস পান নিজামী। ট্রাইব্যুনালের দেয়া ৫টি দণ্ডসহ তিনটিতে মৃত্যুর আদেশ বহাল রাখে আপিল বিভাগ। বাকি দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন নিজামী।
মৃত্যদণ্ড পাওয়া তিন অভিযোগ
১. একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১ টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে ১৪ মে ভোড় সাড়ে ৬টার দিকে বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় ৪৫০ জন মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে সেদিন ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।
২. নিজামীর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে যায় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা। তারা গ্রামের ডা. আব্দুল আউয়াল ও তার আশেপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে।
৩. মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।
রায় দেয়ার আড়াই মাস পর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ১৫৩ পাতার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়, যেখানে গণহত্যা, ধর্ষণ এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের তিন অভিযোগে নিজামীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার কারণ ব্যাখ্যা করেন আপিল বিভাগ।
এর মধ্যে গত ১৫ মার্চ মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিপক্ষে নিজামীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। সেদিনই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো মৃত্যু পরোয়ানা একদিন পর নিজামীকে পড়ে শুনানো হয়। আইন অনুযায়ী রিভিউ আবেদনের শেষ সময় ৩০ মার্চ’এর একদিন আগে করা ৭০ পৃষ্ঠার আবেদনে ৪৬টি কারণ দেখিয়ে নিজামীর পক্ষে রায় পুনর্বিবেচনা চাওয়া হয়।
আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য ২৯ মার্চ আবেদন করে নিজামী। শুনানি শেষে রায় প্রদানের মাধ্যমে যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ঘটে ৫ মে। পাকিস্তানীদের চরম নৃশংসতার প্রধান এই সহযোগীর রিভিউ আবেদন খারিজ করে আপিল বিভাগ সোমবার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করার পর থেকেই ফাঁসি কার্যকরের প্রাক প্রস্তুতি শুরু হয়। ওই রাতেই রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনা) খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেমড সেলে থাকা নিজামীকে পড়ে শোনানো হয়।
আপিল বিভাগ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নকশাকার নিজামী বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে (২০০১-০৬) প্রথমে কৃষি ও পরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। সেসময়কার বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের রায়ে মৃত্যদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত তিনি।