বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাস যারা জানেন, তারা এক নামে চেনেন জাকারিয়া পিনটুকে। ঢাকার মাঠে পিনটু ভাই নামে সুখ্যাত। পেটানো শরীর। মুখে বরিশালী টানের ভাষা। হাত-পা শক্ত। দাপুটে ডিফেন্ডার। ঢাকা স্টেডিয়ামের সোনালি যুগের অন্যতম সেরা ফুটবলার। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত ঢাকা মোহামেডান স্পোটিংয়ের অধিনায়ক।
তখন ঢাকায় ফুটবল খুব জনপ্রিয়। মোহামেডান-আবাহনীর খেলা হলে মাঠ উপচে পড়ে দর্শকে। পত্র-পত্রিকাতেও ঢাকার মাঠের খেলার খবর ফলাও করে ছাপা হতো। গুরুত্বপূর্ণ খেলায় বড় বড় ছবি ছাপা হতো। মনে হয় এসবই যেন এই তো সেদিনের ব্যাপার। বাংলাদেশ বেতারে নিয়মিত ধারাভাষ্য প্রচার করা হতো। আব্দুল হামিদের কণ্ঠস্বর এখনো কানে ধ্বনিত হয়।
সেই যুগের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় জাকারিয়া পিনটু। পিনটু ভাইয়ের অনেক পরিচয়। এদেশের শিশুদের ফুটবল খেলা শেখানোর জন্য পিনটু একাডেমি স্থাপন করেছিলেন। ছোটবেলায় দেখেছি, পিনটু ভাই বিকালে লালবাগ কেল্লার মাঠে ফুটবল প্র্যাকটিস করছেন। পোলাপানদের নিয়ে ফুটবল খেলছেন। পিনটু ভাই একজন লেখক। ’৮০ দশকের শুরুতে কিশোর বাংলা’য় প্রতি সপ্তাহে লিখতেন ছোটদের উপযোগী করে। কীভাবে ফুটবল খেলতে হয়। ওপার বাংলায় চুনী গোস্বামী লিখতেন আনন্দমেলায় খেলতে খেলতে। পিনটু ভাই ১৯৮৪ সালে লস এঞ্জেলেস অলিম্পিক দেখে আসেন। তারপর একটা বই লেখেন। দেখে এলাম অলিম্পিক। বইটি কম্পোজ ও ছাপা হয় মর্জান প্রেসে। নাজমুল হকের স্বত্বাধিকারী। তিনি পরে অনিন্দ্য প্রকাশন প্রতিষ্ঠা করেন।
সেই প্রেসেই পিনটু ভাইয়ের সাথে আমাদের গাড় পরিচয়। একসময় সেই প্রেসে বড় বড় ব্যক্তির আগমন ঘটত। ভালো ভালো কবিতার বই সবই মর্জান টাইপ ফাউন্ড্রিতে ছাপা হতো। সেই প্রেসেই ’৮৭, ’৮৮ সালে দেখা পাই বিমল মিত্র, এম আর আখতার মুকুল, কালাম মাহমুদ, শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন প্রমুখের সাথে। পিনটু ভাই বই ছাপার কারণে প্রায় প্রতিদিন আসতেন। আমরাও যেতাম। পিনটু ভাই আড্ডা দিতেন। কত স্মৃতিকথা বলতেন। পশ্চিম পাকিস্তানী খেলোয়াড়দের সঙ্গে বিরোধ। মালয়েশিয়া, ইরান, ভারতে খেলতে যাওয়া।
পিনটু ভাই অমলেশ, প্রতাপ শংকর হাজরা, নান্নু মঞ্জু প্রমুখের গল্প শোনাতেন। পিনটু ভাই বলেছিলেন, তিনি জীবনে রাত দশটার পরে কখনো জাগেননি। জীবনে কোনদিন চা-সিগারেট খাননি। পিনটু সেইসময় বাসাবো খিলগাঁওতে থাকতেন। একবার রিপোসিং এর কাজে পিনটু ভাইয়ের বাসা গেলাম প্রতাপদা’র সাথে। প্রতাপদারা পিনটু ভাইয়ের অসম্ভব প্রিয়। পিনটু ভাইয়ের স্ত্রী অত্যন্ত মিশুক ও আন্তরিক। সকল খেলোয়াড়দের তিনি আপন ছোট ভাইয়ের মতো আদর করতেন। ভাবী একজন দুর্দান্ত সংগ্রাহক। পিনটু ভাইদের অধিকাংশ ছবি তিনি যত্ন করে সংগ্রহ করে রাখতেন। সেইসব অ্যালবাম যেন বাংলাদেশের ফুটবলের প্রামাণ্য দলিল।
জাকারিয়া পিনটু ছিলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক। বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন। পরবর্তীতে তিনি ভিন্নধর্মী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গৌরবগাঁথা নিয়েও তিনি বই লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সেই স্মৃতি। বলতে বলতে আবেগ মথিত হয়ে ওঠেন পিনটু ভাই। একবার পিনটু ভাই এসেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। আমরা আড্ডা দিয়ে পিনটু ভাইকে বাংলা মটর মোড়ে এগিয়ে দিতে এসেছি। একটা দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে ধরালাম। দোকানী পিনটু ভাইকে দেখে অবাক। লাফ মেরে উঠল।
আপনে পিনটু ভাই না! আপনার খেলা কতো দেখছি। বলে সেই দোকানী উত্তেজনায় কাতর করে কাঁপছে। আমরা টের পেলাম, পিনটু ভাই কতোটা জনপ্রিয়। পিনটু ভাই মৃদু মৃদু হাসলেন। পিনটু ভাই নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। শিশু সংগঠন ‘চাঁদের হাটের’ পরিচালক ছিলেন দীর্ঘদিন। সেই অর্থে তার সাথে আমাদের আরও নিবিড় সাক্ষ্য গড়ে ওঠে। একসময় দেশ জুড়ে চাঁদের হাটের তখন সংগঠন খুব শক্তিশালী ছিল।
পিনটু দেশের প্রত্যন্ত শাখায় শাখায় গেছেন। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। এখনও তিনি চাঁদের হাটের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য। প্রয়াত শাহ আলমগীর পিনটু ভাইকে চাঁদের হাটে সক্রিয় রেখেছিলেন। ’৮০ বছরের অধিক পিনটু ভাই এখন যেন শারীরিকভাবে কিছুটা ভেঙে পড়েছেন। চেহারায় তার রুগ্নতার ছাপ। তবে আমরা যে বলিষ্ঠ ও সুঠাম পিনটু ভাইকে দেখেছি সেটাই স্মৃতিতে অক্ষয় থাকুক। পিনটু ভাইদের মতো বড় মাপের ফুটবলার ও আদর্শিক ব্যক্তিত্ব আর কি জন্ম নেবে বাংলাদেশে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)