জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শিকার উন্নয়নশীল দেশগুলো। নিম্নভূমির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যে এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হতে চলেছে তা বিশ্ব দরবারে বেশ আলোচিত একটি বিষয়।
সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনে খাপ খাইয়ে নিতে নিজেদের এবং তাদের পরিবারের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যয় বহন করে থাকে বাংলাদেশী নারীরা।
বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীপ্রধান পরিবারগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে নিজেদের এবং তাদের পরিবারকে রক্ষা করার জন্য তাদের মোট ব্যয়ের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ করে থাকে বলে জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইইডি) প্রকাশিত এক গবেষণা তথ্য।
বুধবার আইআইইডি প্রকাশিত এই গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে বলে জানায় সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
এতে বলা হয়েছে, বন্যাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত নারী পরিচালিত পরিবারগুলোর ব্যয়ের বড় একটা অংশ জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে লড়াই করতে বরাদ্দ রাখে যা গড়ে ১৫ শতাংশের দ্বিগুণ। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের পুরুষরা ঘর চালানোর দায়িত্ব নারীদের দিয়ে, ঋতুভিত্তিক অন্যত্র কাজ করার জন্য স্থানান্তরিত হয়ে থাকে এবং এসময়ে পুরুষের তুলনায় নারীদের আয় কম হওয়া স্বত্তেও এক্ষেত্রে তাদের বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি থাকে বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণায়।
নিম্নভূমির বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক তাপমাত্রার প্রভাবের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, যার মধ্যে ভয়াবহ মৌসুমী বন্যা, প্রচণ্ড ঝড় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বড় ঝুঁকির কারণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এবং ঝুঁকি কমানোর জন্য গ্রামীণ পরিবারগুলোর সাধারণ পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে বাড়ির ভিত্তি মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে রাখা, গাছ লাগানো এবং গবাদি পশুকে নিরাপদ রাখার জন্য আশ্রয়স্থল তৈরি করা।
আইআইইডি’র প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণার লেখকদের একজন পল স্টিল বলেন, জলবায়ু অভিযোজনের জন্য অবধারিতভাবে পুরুষরা বেশি পরিমাণে ব্যয় করে থাকে, অন্যদিকে নারীদের স্বল্প আয়ের একটি বৃহত্তর অংশই এর জন্য ব্যয় করতে হয়।
গবেষণার জন্য আইআইইডি, কিংস্টন ইউনিভার্সিটি লন্ডন এবং বাংলাদেশে ইউএন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ১০টি জেলায় ৩ হাজার ৯৪টি গ্রামীণ পরিবারে জরিপ চালিয়ে কীভাবে লিঙ্গ ও আর্থ-সামাজিক কারণগুলো ঝড়, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা এবং তাপের মতো বিপর্যয় থেকে পরিবারগুলোকে রক্ষা করার জন্য ব্যয়কে প্রভাবিত করে তা বিশ্লেষণ করা হয়।
গবেষকরা দেখেছেন ৪৩ শতাংশ পরিবার বন্যা, ৪১ শতাংশ পরিবার ঝড় এবং ৮৩ শতাংশ খরা বা লবণাক্ততার মতো দীর্ঘমেয়াদী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে।
২০২১ সালেই প্রত্যেকটা পরিবারই এই বিপর্যয় মোকাবেলায় আনুমানিক সাড়ে ৭ হাজার টাকা ব্যয় করেছে, যা বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর হিসেবে প্রায় ১৭০ কোটি টাকারও বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছে গবেষকেরা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশ সরকার এবং দাতা দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সরাসরি মোকাবিলাকারী দরিদ্র পরিবারগুলোকে আরও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে, বিশেষত নারীদের পরিচালিত পরিবারগুলোকে, যারা এর ভার বহন করছে।
আইআইইডির ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রামীণ এলাকায় বাংলাদেশী পরিবারগুলো প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য প্রস্তুতি এবং মোকাবেলা করার জন্য দেশটি যে বৈদেশিক সহায়তা পেয়েছিল তার চেয়ে ১২ গুণ বেশি ব্যয় করেছে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ দ্বিজেন মল্লিক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তেন কারণে ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা করতে দরিদ্র শহুরে পরিবারগুলোর সৃষ্ট ক্ষতি এবং ধ্বংসের পরিমাণ হিসেব করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং নারী কর্মী গোষ্ঠী নারিপোকখোর সদস্য মাহফুজা মালা জানান, আইআইইডি গবেষণায় দেখা গেছে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মোকাবিলা করার প্রচেষ্টা কীভাবে পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে আলাদাভাবে কাজ করে।
তিনি আরও বলেন, নারীদের কাজ প্রায়শই অবৈতনিক এবং অস্বীকৃত রয়ে যায়, একইভাবে অভিযোজনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাও কখনো কখনো অস্বীকৃতই থেকে যায়।
গবেষণায় দেখা যায়, পুরুষ পরিচালিত পরিবারের তুলনায় নারী পরিচালিত পরিবারে পুরো বাজেটের ২ শতাংশ বেশি ব্যয় করা হয় বন্যা মোকাবেলায় এবং ৩ শতাংশ বেশি খরচ করা হয় অতিরিক্ত গরমের মতো বিপর্যয়ের জন্য। কিন্তু যখন ঝড়ের বিষয় আসে, তখন নারী প্রধান পরিবারগুলো ৩০ শতাংশ পয়েন্ট ব্যয় করে, যদিও ঝড়প্রবণ দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এমন পরিবারের সংখ্যা এখন কম।
মালা বলেন, নারীদের বন্যা বা ঝড়ের জন্য প্রস্তুতি নেয়া এবং মানিয়ে নেয়ার যে প্রকৃতি রয়েছে তা তাদের সমাজে আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করার গুরুত্বকে নির্দেশ করে।