চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ভিন্ন স্বাদের চা নিয়ে জনারণ্যে মিলিয়ে থাকা এক উদ্যোক্তা

সাকিব আল হাসানসহ অনেকে ক্রিকেটার তার চায়ের ভক্ত

ততক্ষণে চায়ের স্বাদ লেগে গেছে মুখে।  কম রেজুলেশনের ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে যাবো। ভাবছি ভালো ক্যামেরা-ফোনের প্রয়োজনীয়তা অনেক। পথচলতি এক বন্ধু মনোযোগ ভাঙলেন।  গল্পগুজব হলো।  বললেন, চা খাবেন? বললাম একটু আগেই খেলাম।  তিনি কাসুন্দি মাখা পেয়ারা সাঁধলেন।  আমি ভাবলাম, চায়ের স্বাদটা আরো কিছুক্ষণ থাক।  বললাম, খাবো না ভাই।  বন্ধুদের বিদায় দিয়ে আবার সাওমি নোট ফোর বের করে ছবি তুলতে গেলাম।  কেবল ফ্লাশ জ্বালিয়েছি, চা দোকানের ছেলেটি বললো, ফুটো তোলেন নাই? আমি বললাম, তুলছিলাম ফ্লাশ ছাড়া, ভালো হয় নাই।  সে তার পকেটে থাকা মোবাইল বের করে অকারণে একটি ছবি তুলে আবার পকেটে রেখে দিল।

দোকানহীন অনেকটা ভ্রাম্যমাণ চায়ের স্টলে এমন ব্যস্ততা ও ভিড় দেখা যায় না।  কয়েকটা বড় ফ্লাক্সে চাপের পর চাপ চলছে অতি যত্নে। নীচে গোটা বিশেক কাঁচের গ্লাসের ভেতরে প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম গ্লাস বসানো।  কৌশলটি এর আগে দেখিনি।  পাশে প্রচুর ছোটো আকারের লেবু তার ওপরে হর্লিক্স, কফি ইত্যাদির বয়াম।  মানুষ এসে দাঁড়াচ্ছে চা চাইছে তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে চলে যাচ্ছে।  কাঁচের গ্লাসের ভেতর থেকে প্লাস্টিকে ওয়ান টাইম বের করে ডাস্টবিনে ফেলা হচ্ছে।  পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ ডক্টরস চেম্বার আটতলা ভবনটির নীচের একপাশে নীরবে চলছে তৃপ্তিকর চায়ের অদ্ভুত বিকিকিনি।  কয়েকটি ছবি তুলে দিক পাল্টালাম।  একজন চায়ের দোকান ঘেঁষে আধবসা হয়ে বেশ সুরেলা কণ্ঠে গান ধরেছে।  সাবধানে তাকে বাদ দিয়ে ফ্রেম করার চেষ্টা করছি।  চা দোকানের দুইটি ছেলে ততক্ষণে নীরবে আমাকে প্রশ্রয় দিয়েছে।  আমি ছেলেটির গানে কিছুটা বিরক্ত।  যদিও কণ্ঠটা ভালো।

হঠাৎ মনে হলো, চা নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিব।  লিখবো, ‘কলকাতার মাটির ভাড়ের চা দেখে আমরা অনুকরণ করি না।  আমরা উদ্ভাবণ করি, কাঁচের গ্লাসের ভেতর প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম।  বিশেষ ধরণের লেবু আর আদায় মেশা সুমিষ্ট চা।  একবার পান করলে আরেকবার আসতে বাধ্য হতে হয়’।

প্রতি কাপ চায়ের দাম দশ টাকা।  ফ্লাক্সে আনা হয়।  কত কাপই বা বিক্রি হয়?

আবার শুরু হলো গান।  লক্ষ্য করলাম, গানের কথা পাল্টে খুব কায়দা করে জানানো হচ্ছে চা পানের আহ্বান।  মনে হলো, ভাসমান বা ভ্রাম্যমাণ চা দোকানটির সঙ্গে এই গায়ক ছেলেটির কোনো সম্পর্ক আছে।  দেখলাম দোকানের চঞ্চল দুই কিশোরকে সে মিষ্টি সুরে কিছু নির্দেশনাও দিচ্ছে।

বললাম, দোকানটি কি আপনার? সে নির্লিপ্তভাবেই জবাব দিল জ্বি।  খুব বেশি জারিজুরি না করে একবারেই জানতে চাইলাম, দৈনিক কয় কাপ যায়?

: এক হাজার কাপ তো হবেই।

: খুব ভালো তো! কয় রকমের চা করেন?

: ছয় সাত রকমের।  লেবু চা, আদা চা, হরলিক্স চা, মাসালা চা, কফি চা।  আরও মিক্সড চা আছে কয়েক রকমের।

: ফ্লাক্সে চা আনেন গন্ধ হয়ে যায় না?

: বলেন কি? একেক ফ্লাক্স চা শেষ হতে কি সময় লাগে? পাশেই ফ্যাক্টরি আছে।  তিন ফ্লাক্স শেষ হতেই, নতুন তিন ফ্লাক্স এসে যায়।

: আপনার চায়ের স্বাদ তো আলাদা।  বিশেষত্বটা কি? এগুলো কি আপনি নিজেই করেন?

: হ্যাঁ, আমি নিজে হাতেই সবাইকে শিখিয়ে নিয়েছি।

ছেলেটির মুখের প্রতিটি বাক্যই ভাবনার খোরাক দেয়।  ওর বলতে ভালোলাগে আর আমার শুনতে।  আগে একটি দোকান ছিল।  অল্প বয়সে প্রেম করে সবকিছু উড়িয়ে বছর পাঁচেক আগে চায়ের টং দোকান দিয়েছিল হান্নান।  প্রথম প্রথম কেতলি ভরা পাতি ড্রেনে ঢেলে দিতে হয়েছে।  চা খেয়ে ক্রেতা মুখ বিষ করে, টাকা দিতে চায় না।  এসব দেখতে দেখতে চায়ের পেছনে লাগে সে।  ভালো স্বাদের চা বানানোর জন্য রাতের ঘুম হারাম করে দেয়। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর একসময় ওর হাতেই যাদু এসে ধরা দেয়।  শুরু হয় চা বাণিজ্যের নতুন ভাবনা।  নানান স্বাদের চা আর ভিন্নতর পরিবেশন নিয়ে সে হাজির হয় চা প্রেমী নাগরিকের সামনে।  যাদু এসে যায় বাণিজ্যেও।  তারপর দিনে দিনে পাঁচটি এমন অস্থায়ী চা স্টল।  সাইনবোর্ড নেই, ব্যানার নেই তারপরও তার বিশেষ চা চিনে নিতে ক্রেতার ভুল হয় না।

হান্নান বলে যাচ্ছে।  আমি অবাক হলেও নির্লিপ্ত চেহারা নিয়ে ওর কথা শুনছি।  কিছুক্ষণ পর পর ছোট ছোট জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দিচ্ছি।  শুধু চা ই আছে তার এই আয়োজনে।  বিস্কিট, পানি কিচ্ছু নেই।  নেই বসার ব্যবস্থা।  হান্নান বললো, দাঁড়ানোর ব্যবস্থাও নেই।  কারণ, ভবনের নীচের ফুটপাত।  এখানে দাঁড়ানো যায় না।  বললাম, ভাড়া দিতে হয় না? ওর জবাবটা দারুন। ‘টাকা দিতে হয় না।  ব্যবহার দিতে হয়।  সবিনয়ে চেয়ে নিয়েছি।  বলেছি, মেহেরবানী করে আমাকে একটু সাহায্য করুন।  ভবন মালিক সাহায্য করেছেন।  আমার তো মনে হয়, এখনও মানুষ মানুষকে সাহায্য করে।’

স্মার্ট এক তরুণ হান্নান।  কিছুক্ষণেই শ্রদ্ধা এসে গেল ওর প্রতি।  মুখে সাফল্য আর আত্মবিশ্বাসের হাসি।  সে গর্ব করেই বললো, স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছে।  জানতে চাইলাম, আপনি পড়েছেন কতদূর? কিছুটা সংকুচিত হয়ে বললো, সামান্য।  ডিগ্রি পাস করতে পারিনি।  মনে হয়, ভালোই হইছে।  লেখাপড়া শেষ করতে পারলে হয়তো সফল হতে পারতাম না।  কার সাফল্য কীভাবে আসে কেউ জানে না।  অল্প বয়সে প্রেম করে টাকা পয়সা ওড়াইছি।  ওইটাও ঠিক আছে।  তা না হলে আজকের এই শক্তি পাইতাম না।  একটা ধাক্কা ছাড়া কিছু হয় না।  ওইটা আমার জীবনের ধাক্কা। হান্নানের কথা শুনে যারপরনাই অবাক হলাম।  বললাম, তোমাকে নিয়ে বড় রিপোর্ট টিপোর্ট হওয়া উচিৎ।  সে বললো, এখনও তো কোনো কথা বলিই নাই।  আমার কাছে চা খাইতে সাকিব আল হাসান, নাসির থেকে শুরু করে সবাই আসে।

মোবাইলে রিং এলো।  আমি আস্তে করে হান্নানের হাতটা নিয়ে হ্যান্ডশেক করে চলে এলাম।  ফোন ছেড়ে ভাবতে থাকলাম, একহাজার কাপ চা, পাঁচটা দোকান, একটি কারখানা, প্রতি কাপ চা ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা।  তাহলে হান্নান তো বিস্ময়কর এক উদ্যোক্তা, অথচ দেখলে মনে হয় কর্মসন্ধানী বেকার তরুণ।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।