বিশ্বে পাকিস্তান নামক এক রাষ্ট্র আছে। যেখানে সুদীর্ঘকাল যাবৎ জঙ্গিবাদের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির বসবাস এক ছাদের তলে। কখনো বিছানায় তারা একত্রে যাপন করে। আবার কখনো কখনো অভিমান করে বিছানা থেকে একজন হয়তো মেঝেতে শুয়ে পড়ে। তবে সুমধুর দাম্পত্যের টানে সেই বিচ্ছেদ খুব একটা দীর্ঘ হয় না। এই বন্ধন যে তাদের কতোটা সুদৃঢ়, তার নজির অতীতে বহুবার মিলেছে। এখনো তারা সেই দৃষ্টান্ত টানতেই ব্যস্ত। কাজেই জঙ্গিবাদের বিস্তারের পেছনে তাদের প্রভূতঃ অবদানকে কেউ কোনোভাবে বিপণ্ণ করলে দাম্পত্য অংশীদার পাকিস্তানি পররাষ্ট্রনীতি তার পেছনে লেগে পড়ে মরিয়া হয়ে। এমন বাড়াভাতে ছাই তারা সহ্যই বা করবে কেন!
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক যে নর্তন কুর্দন, তা শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে বলেই, আমি তা মনে করতে রাজি নই। বরং বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচার প্রক্রিয়ায় সঙ্গতভাবেই যারা প্রথম সারির অপরাধী, সেইসব জামায়াত ও বিএনপি নেতারা এ অঞ্চলে জঙ্গিবাদের বিস্তারে পাকিস্তানী কৌশলের অংশীদার হিসেবে কাজ করতেন বলেই তাদের এই গাত্রদাহ। যদিও সেই পাকিস্তানী কৌশল বরাবরের মতোই মেড ইন অন্য কোনো রাষ্ট্রে! সে প্রসঙ্গে পরে আসি। আপাতত পেছনে ফিরে দেখি, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির দাম্পত্যসঙ্গী জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতাকে সাম্প্রতিক সময়ে কীভাবে চপেটাঘাত করেছে।
মাজহার খান কিংবা ফারিনা আরশাদ কাহিনি নতুন করে বলার কিছু নেই। শুধু দুটো বিষয় খেয়াল করার মতো, মাজহারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের জাল নোট ব্যবসা বিস্তারে সহায়তা দেয়ার যে অভিযোগ উঠে এসেছিলো, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সে ব্যাপারে এখনো আমরা প্রকাশ্য কোনো মন্তব্য পাইনি। এখানেই শেষ নয়, গত কয়েক বছরে নানা ঘটনায় বাংলাদেশে জঙ্গি সম্পৃক্ত তৎপরতায় সবচেয়ে বেশি আটক হয়েছে পাকিস্তানি নাগরিক। এদের ব্যাপারে পাকিস্তানের কঠোর মনোভাব আমরা কখনোই বুঝতে পারিনি। তাদের পররাষ্ট্রনীতি আর জঙ্গিবাদের দাম্পত্যে উৎপন্ন এসব বেহিসেবি সন্তানকে নিয়ে পাকিস্তান কোনো লজ্জাবোধও করে না।
২০০৮ সালে ঢাকায় নওশাদ আলম খান নামের একজনকে জাল মুদ্রাসহ আটক করা হয়েছিলো। ইউএস ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই নওশাদ আলম খান লস্কর ই তাইয়্যেবার তিন শীর্ষ অর্থদাতার একজন। অথচ পাকিস্তানের একে নিয়ে মাথাব্যথার কোনোকিছুই আমরা দেখিনি। তাদের যতো মাথাব্যথা আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে! এমন সাচ্চা পাকিস্তানি শুভার্থীদের ফাঁসি দিয়ে বাংলাদেশ তো তাদের চক্ষুশূল হবে- এটাই স্বাভাবিক। জঙ্গি অর্থদাতাদের ধরবে, প্রশিক্ষণ দিতে এলে আটক করবে, তাদের দালালদেরকে যুদ্ধাপরাধে ফাঁসিতে ঝোলাবে বাংলাদেশ, আর পাকিস্তান তাকে ছেড়ে দেবে? যে রাষ্ট্রটি টিকেই আছে জঙ্গি জন্মদাতা রাষ্ট্রের খেলার মাঠ হিসেবে, তাদের যদি আঞ্চলিক জঙ্গিবাদ উস্কানোর টুলগুলো একে একে মুখ থুবরে পড়তে থাকে, তাহলে তাদের বাণিজ্যটা হবে কীভাবে! কাজেই পাকিস্তান যা করার তাই করছে।
২০১৫ সালে আবু মোহাম্মদ আল আদনানি নামের একজন যে এ অঞ্চলে আইএস-এর খোরাসান নামক নতুন রাষ্ট্র তৈরির খোয়াব দেখার কথা ঘোষণা করেছিলেন, সেই খেলার প্রস্তুতিতে পাকিস্তান তো একটা বড় অনুষঙ্গই বটে! এমন প্রাইম টাইমে বাংলাদেশ যে বেরসিকের মতো আচরণ করছে, তা পাকিস্তান সহ্য করবে কেন! তারপরেও আমরা কখনো কখনো পাকিস্তানে গণতন্ত্র খুঁজি। আমরা সবকিছু গুলিয়ে ফেলি। বহু লম্বা চওড়া লেকচার ঝাড়ি! কিন্তু ভুলে যাই, পাকিস্তানে যে টিটিপি জামাই আদর পায়, সেই সংগঠন আজ থেকে বছর তিনেক আগেই আইএস-এর ৫ দফার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করেছে প্রকাশ্য ঘোষণায়। এখনো হাফিজ সাঈদের মতো জঙ্গি সর্দার পাকিস্তানে সুরক্ষা পায়। এই লোকটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত। তারপরও তাকে আশ্রয় দেয়ায় তারানকো টাইপ কোনো ইউএন কেরানী ছুটে ছুটে পাকিস্তানে যান না! তার জন্য কেউ ফোন-টোনও দেন না! কূটনীতিকও প্রত্যাহার করেন না। করবেন কীভাবে? সবার ল্যাঞ্জা যে একসাথেই গিট্টু দেয়া!
তাই তো নিজামীর জন্য যে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান কেঁদে কেটে বুক ভাসায়, সেই জামায়াতই পেশোয়ারের ঘটনার পর পাকিস্তানে সর্বদলীয় রাজনৈতিক বৈঠকে টিটিপির বিরুদ্ধে অভিযানের জোর বিরোধিতা করে। বোঝাই যায়, একে অপরের সঙ্গে তারা কতোটা অঙ্গাঙ্গী! এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উদ্বেগ নেই। নিশা দেশাই ছুটে ছুটে যান না! তাদের যতো উদ্বেগ বাংলাদেশ নিয়ে! বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ দমনে আঞ্চলিক টাস্কফোর্সের পক্ষে কথা বললেও পাকিস্তান যে সেটার বিরোধী, সে নিয়েও উদ্বেগের আর কী আছে! ভূরাজনৈতিকভাবে চীন আর ইরানকে মোকাবেলা করতে হলে, পাকিস্তান একটি বড় হাতিয়ার হতে পারে। অতীতেও হয়েছে। চীনের জিংজিয়ানে জঙ্গিদের সক্রিয়তার যেসব খবর পাওয়া যায়, তার সঙ্গে পাকিস্তানের গুড এবং ব্যাড উভয় তালেবানেরই যোগাযোগ আছে। ইরানও বারবার অভিযোগ করেছে, বেলুচ সীমান্তপথে জঙ্গিরা তাদের রাষ্ট্রে ঢুকছে। কাজেই ব্রুস রিডলের মতো মানুষদের গলাবাজিতে ভজে আমরা যারা ভাবি যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তাদের আপাতত ভাবনা বাদ দিয়ে নিপাট দর্শক হয়ে গ্যালারিতে স্রেফ বসে যাওয়া উচিত!
বাংলাদেশকে নিয়ে যে খেলাটা চলছে, তার ফলাফল সম্পর্কে বাংলাদেশ মোটেই সচেতন নয়, এমনটা যারা ভাবেন, তাদের চপেটাঘাত ভক্ষণ করার সময় হয়ে এলো বলে! ব্রিকস গোষ্ঠীকে ঠেকাতে হলে এশিয়ায় যাদের কাজিয়া দরকার, তারা খেলাধূলা খুব সুন্দর গুছিয়েই এনেছিলো! কিন্তু আফসোস, বাংলাদেশ নিয়ে তারাই মাত্রাতিরিক্ত খেলাধূলা করতে গিয়ে সেই গোছানো ছকটিই উল্টে দিলো! আগামী অক্টোবরে ভারতের গোয়াতে এর প্রমাণটা খুব ভালোভাবেই পাওয়া যাবে আশা করি। কাজেই পাকিস্তান-তুরস্কের এই শেষ সময়ের গুটিবাজির মেয়াদটাও খুব বেশিদিন নয় বলেই মনে হয়।
শেষে একটা অফটপিক। বঙ্গোপসাগর লোভনীয়, তবে বিশ্বের একমাত্র মহাসাগরের অংশ এটি, যে মহাসাগরের নিজস্ব মৌসুমী বায়ুর ধরন বুঝতে না পারলে আগেকার দিনে বহু দশাসই নাবিক বেমালুম গায়েব হয়ে যেতো!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)