২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে এক চরম হত্যাযজ্ঞ চালায় একদল জঙ্গি। এদের নামকরণ ছিল হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ সংক্ষেপে হুজি বি। শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করাই ছিল সেদিনের এই হামলার লক্ষ্য। ১৯৯৯ সালের মার্চ থেকে ২০০৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় বছরে এই জঙ্গিগোষ্ঠী দেশে মোট ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। এসব হামলায় ১০৬ জন নিহত ও আহত হন ৭০০–র বেশি মানুষ। তারা হামলা চালায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে, সিপিবির সমাবেশে, উদীচী ও ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। তারা হামলা চালায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর। তারা হামলা চালায় ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপরে। এই সময়কালে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে চার দফা হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
১৯৯২ সালে যখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় তখন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ সংক্ষেপে হুজি বি ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আত্মপ্রকাশ করে। এমন একটি উগ্র জঙ্গি সংগঠন সেদিন কার মদদে সংবাদ সম্মেলন করার সুযোগ পেয়েছিল? জাতীয় প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ কেনইবা এদেরকে এ সম্মেলন করার সুযোগ দিয়েছিলো। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলেও জঙ্গি হুজি বি থেমে থাকেনি। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সময়কাল ছিল তাদের নির্বিঘ্ন নাশকতা চালানোর সময়। তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ ও তাদের সংগঠন। ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে বেড়ে ওঠা জঙ্গিরা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও নাশকতা চালাতে থাকে।
১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগের শাসনামলেও বেশ কয়েকবার বড় ধরণের বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। ২০০০ সালের জুলাইয়ে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভাস্থল ও হেলিপ্যাডের কাছে বোমা পুঁতে রেখে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। কোটালীপাড়ায় হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর ২০০১ সালের ৩০ মে খুলনায় রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তিন দিন আগে ২৭ মে সেতুর কাছাকাছি রূপসা নদী থেকে দুটি ইঞ্জিন নৌকাভর্তি ১৫ জঙ্গি ধরা পড়ে যাওয়ায় সেটিও আর সফল হয়নি।
এরপরও শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা হতে পিছু হটেনি তারা। ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে নির্বাচনী জনসভায় হত্যার পরিকল্পনা করে হুজি বির জঙ্গিরা। কিন্তু শেখ হাসিনা সিলেট পৌঁছান নির্ধারিত সময়ের অনেক পর।তাই তাদের মিশন ব্যর্থ হয়। জনসভাটি ছিল সিলেট শহরের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে। তিনি সভাস্থলে পৌঁছার পর রাত আটটার দিকে কাছাকাছি এলাকায় একটি মেস ঘরে জঙ্গিদের তৈরি বোমা কোনো কারণে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। শেখ হাসিনা তখন সভামঞ্চে ছিলেন। এ ঘটনায় ঘটনাস্থলে দুই জঙ্গি নিহত হয়। জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা আরও ভয়ানক হয়ে উঠে ২০০১ সালে আবার বিএনপি জামাত জোট ক্ষমতায় এলে। বিভিন্ন নামে তারা বেড়ে উঠতে থাকে৷ এই বেড়ে ওঠার ধারাবাহিকতাতেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভামঞ্চে গ্রেনেড হামলা চালায় তারা।
২০০৪ সালে রাজশাহীতে চরমপন্থী দমনের নামে পুলিশের সহযোগিতায় জাগ্রত মুসলিম জনতা (জেএমবি) নাম নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করে। কেন কী উদ্দেশ্যে পুলিশ তাদের সহযোগিতা করলো সেদিন? এভাবেই জঙ্গিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে নাশকতা শুরু করে। বিএনপির কয়েকজন মন্ত্রী ও সাংসদের বিরুদ্ধে এই জেএমবি পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ ওঠে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর বিএনপি সরকার জেএমবি দমনে অভিযান শুরু করলেও নামে বেনামে এরা থেকেই যায়। তাদের এ অভিযানে আন্তরিকতা ছিলোনা। সেটা ছিল একধরনের আইওয়াশ ধর্মী। মিডিয়ায় লেখালেখি ও দেশী-বিদেশী সমালোচনার মুখে তারা এ অভিযান চালাতে বাধ্য হয়েছিল মাত্র।
শায়খ আবদুর রহমান জেএমবি প্রতিষ্ঠা করে ১৯৮৮ সালে। এরপর তিনি কিছুদিন সৌদি ও কুয়েত দূতাবাসে চাকরি করেন। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে তাকে দূতাবাসের চাকরির সুযোগ করে দিলো কে? এরপর দূতাবাসের চাকরি ছেড়ে জামালপুরে এসে সার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন শায়খ আব্দুর রহমান। দেশের বিভিন্ন চরমপন্থি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে জেএমবিকে শক্তিশালী করেন তিনি। আফগান যুদ্ধ শুরু হলে শায়খ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে বেশকিছু জঙ্গি এতে অংশ নেয়। তালেবানদের বিজয়ের পর দেশে ফেরেন তারা। এসময়কালেই তারা আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেখানে থেকে তারা বোমা তৈরি, বিস্ফোরণ দক্ষতা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নেয়। আফগান যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে ১৯৯৮ সালে নতুন করে জেএমবির কার্যক্রম শুরু করে তারা। এসময় তারা সদম্ভে বলতে থাকে, আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান। ২০০৩ সালের মাঝামাঝি থেকে শায়খ আব্দুর রহমানের পরামর্শে ও বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ বা জেএমজেবি নামে আরও একটি জঙ্গি সংগঠন গঠিত হয়। এভাবেই এরা কখনো জেএমবি কখনো জেএমজেবি, কখনো হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ, কখনো হিযবুত তাহরীরসহ বিভিন্ন নাম ধারণ করে। আর এদের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকে দেশী-বিদেশী উদ্দেশ্যবাজ মহল। এই উদ্দেশ্যবাজরাই কি জঙ্গিবাদের মূলে নয়?
শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই, মুফতি হান্নানের ফাঁসি হয়েছে কিন্তু উদ্দেশ্যবাজদের বিচার হয়েছে কি? এদের চিহ্নিত করে নির্মূল না করলে তারা আবারও নতুন আব্দুর রহমান, নতুন বাংলা ভাই ও নতুন মুফতি হান্নান বানাবেনা কি? কেন এদেরকে আড়াল করতে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হয়? ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে আড়াল করতে জজ মিয়া নাটক সাজানো হলো। কাউকে কাউকে এমন কথাও বলতে শোনা গেল যে শেখ হাসিনা তার ভ্যানেটি ব্যাগে ভরে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন!মিথ্যাচারের মাধ্যমে মূল অপরাধীদের আড়ালকারীরা কি জঙ্গিবাদের ক্ষেত্র রক্ষাকারী নয়? এই জঙ্গি হামলার বিচার প্রক্রিয়াটি বিএনপি শাসনামলে শুরু হতে পারলোনা। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও না। বিচার প্রক্রিয়াটিকে শুরু হতে হলো ২০০৭ সালে সেনাশাসিত তত্তাবধায়ক শাসনামলে।
এটা কি এদেশীয় রাজনৈতিক সরকার গুলোর চরম ব্যর্থতা নয়? এদের পেছনে এমন কি মহাক্ষমতাধর মহল যাকে রাজনৈতিক সরকার ভয় পায়? এদের চিহ্নিত না করে কেবল আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই ও মুফতি হান্নানকে ফাঁসি দিলেই জঙ্গি নির্মূল হবে না। নির্মূল করতে হলে চাই ক্ষেত্র রক্ষাকারীদের নির্মূল। এটি না করতে পারলে নামে বেনামে জঙ্গি সংগঠন করে নতুন নতুন আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই ও মুফতি হান্নান আসতেই থাকবে। রাক্ষস কর্তৃক অপহৃত রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে পাতাল পুরীতে গিয়েছিল এক যুবরাজ। রাক্ষসকে নিধন করতে হলে যুবরাজের প্রয়োজন হয় কৌটার ভেতর থাকা প্রাণভোমরাটিকে নির্মূল করা। ছোটবেলায় এ গল্পটি আমরা বহুবার পড়েছি। প্রাণভোমরাটি রেখে রাক্ষস নিধন ও রাজকন্যার মুক্তি কোনটাই সম্ভব ছিলোনা। জঙ্গিবাদেও সে গল্পের মতই জঙ্গি নিধন ও শান্তির মুক্তিটি হয়ে উঠছে প্রাণভোমরা। এর প্রাণভোমরা হলো উদ্দেশ্যবাজ কারিগররা৷ এদের রেখে জঙ্গি নির্মূলের বাসনা সেই গল্পের প্রাণভোমরা রেখে রাক্ষস নিধনের মতো নয় কি?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)