ছোট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আজকের শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো চরম নিন্দনীয় ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিলো।
‘একদম শুরু বলতে সেটা শুরু হয়েছিলো পোষ্য কোটা অনুমোদন নিয়ে,’ জানিয়ে একজন শিক্ষক বলেছেন: ওইখান থেকেই শুরু। তারপর সেটা আন্দোলনে রূপ নেয় একটা সেমিনার লাইব্রেরি বসানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করে অন্য একজন শিক্ষক বলেন, বর্ধিত একাডেমিক ভবনের একটা রুম কোনো লিখিত কাগজপত্র ছাড়াই সেমিনার লাইব্রেরির জন্য সিভিল ডিপার্টমেন্টকে দিয়ে দেয়া হয়। সিভিলের প্রধান যেহেতু ভিসির অনুগত ছিলেন, তাই সেমিনার লাইব্রেরির জন্য তিনি ভিসির কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে এসেছিলেন।
কিন্তু, যেহেতু সিভিল ডিপার্টমেন্ট অন্য ভবনে, তাই ‘এ’ বিল্ডিংয়ে অবস্থিত বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরা বাইরের ভবনের একটি বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরি ‘এ’ বিল্ডিংয়ে মেনে নিতে পারেননি।
সেজন্য ফিজিক্স, ট্রিপল ই , সিএসই, জিওগ্রাফি এবং বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধানরা ভিসির কাছে প্রতিবাদ জানাতে যান। এই ডিপার্টমেন্টগুলো ‘এ’ বিল্ডিংয়ে অবস্থিত।
অন্য একজন শিক্ষক বলেন: সেখানে যাওয়ার পর ভিসি তাদের কথাতো শোনেনই নি, বরং অপমান করে তাড়িয়ে দেন। উপাচার্য তাদের বলেন, রুম বরাদ্দের জন্য তার মৌখিক অনুমতিই যথেষ্ট।
এই ঘটনার পরপরই শিক্ষকসহ ওই বিভাগগুলোর শিক্ষার্থীরা ভিসি অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। শিক্ষকদের আশ্বাসে ছাত্র-ছাত্রীরা অবশ্য দুইদিন পর ক্লাসে ফিরে যায়।
কিন্তু শিক্ষকদের একটি অংশ ভিসির বিরুদ্ধে আগের যে অভিযোগগুলো ছিলো সেগুলোকে সামনে প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। একজন শিক্ষক জানান, আমিনুল হক ভূইয়া ভিসি হওয়ায় যারা মনক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন এবং যারা পোষ্য কোটার বিরুদ্ধে ছিলেন; তারাও এ আন্দোলনে যোগ দেন। সবাই মিলে নতুন করে শুরু করেন আন্দোলন।
একাধিক শিক্ষক জানান, এভাবে উপাচার্যের পক্ষে-বিপক্ষে দুটি দল তৈরি হয়, যার চরম প্রকাশ ঘটেছে শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো ঘটনায়। তারা বলেন, অন্য জায়গার মতো এখানেও ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ ভিসির পক্ষে দাঁড়ায়। ভিসিপন্থী শিক্ষকরাও ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এবং বর্তমান শিক্ষার্থীরাও বলছেন, মূলতঃ শিক্ষক রাজনীতিকে কেন্দ্র করে ছাত্ররাজনীতির নোংরা প্রকাশ ঘটেছে।
তারা মনে করিয়ে দেন, এ রাজনীতির কারণেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটার পর এক ঘটনা ঘটছে। ক্রমাগত অস্থিরতা পুরো ক্যাম্পাসকেই জর্জরিত করে ফেলেছে। এ কারণে কখনো তীব্র আন্দোলন, কখনো শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আবার কখনো শিক্ষকদের লাঞ্ছনার মতো ঘটনা ঘটছে।
একইরকম বললেন সাবেক শিক্ষার্থী প্রশান্ত রায়।
শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। এখন সফটওয়্যার কোম্পানি ডাটাক্রাফটের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পড়াশোনার সময় যুক্ত ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। ছিলেন ডিবেটিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট।
তার মতে, এসব কোন্দলের পেছনের মূল কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক। তবে আগেকার ছাত্ররাজনীতি আর এখনকার ছাত্ররাজনীতির মধ্যে বিস্তর ফারাক। তখন আমরা শিক্ষকদের জন্য সম্মান রেখেই রাজনীতি করতাম। স্যারদের সঙ্গে বসে গল্প করতাম। আর তখন কোনো রাজনৈতিক দলই এখনকার মতো এতোটা আগ্রাসী ছিলো না।
‘আর এখন তো রাজনীতির মূলনীতিই নেই কারো মধ্যে। সে কারণেই এরকম ঘটনা ঘটছে,’ বলে মন্তব্য করেন প্রশান্ত রায়।
তবে সঙ্গে শিক্ষকদের দলাদলিকেও দুষছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির আরেক সাবেক ছাত্র নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ। তিনিও প্রশান্ত রায়ের মতো ১৯৯৭ সালে লেখাপড়া শেষ করেছেন। পদার্থ বিজ্ঞানে পড়াশোনা করে এখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তিনি।
চ্যানেল আই অনলাইনকে নিজাম উদ্দীন বলেন, এখন শুধু ছাত্ররাই নয়; শিক্ষরাও ভাগ হয়ে পড়েছেন। তারা নানা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। অস্থিরতার এটাও একটা কারণ। এমনকি দলে দলে ভাগ হয়ে একদল শিক্ষক আরেকদল শিক্ষকের উপর হামলার উসকানি দিচ্ছেন। ‘সেসবও এমন লজ্জাজনক অবস্থার কারণ,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে সবকিছুর পরও শিক্ষকদের লাঞ্ছনার খবরে সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে তারা দুইজনই হতবাক। এজন্য দ্রুত সবকিছুর সমাধানের পক্ষে তারা।
প্রশান্ত রায় বলেন, যারা এসব কোন্দল তৈরি করছেন তাদের মূল দলের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা যদি তাদের কর্মীবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চান তাহলে সেটা অবশ্যই সম্ভব।
আর নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ মনে করেন, মূল রাজনীতি থেকে ছাত্র রাজনীতিকে আলাদা করে ফেলতে হবে। ঢাকায় দুটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলন হলো মানেই ছাত্রদেরও আন্দোলন করতে হবে, তেমনটা যেন না হয়। তাহলেই এই সমস্যার সমাধান আনা সম্ভব।