“আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা
আমি জনম জনম রাখবো ধরে ভাই হারানোর জ্বালা
আসি বলে আমায় ফেলে সেই যে গেলো ভাই
তিন ভুবনের কোথায় গেলে ভাইয়ের দেখা পাই। ”
মানবীয় সম্পর্কগুলোর মধ্যে ভাই বোনের যে মধুর সম্পর্ক তা কেবল আবেগ আর অনুভূতি দিয়েই অনুধাবন করা সম্ভব। কোন বোনের অনেকগুলো ভাইয়ের মধ্য থেকে যদি একটি ভাইও তার কাছ থেকে হারিয়ে যায় তবে সেই ভাই হারানোর জ্বালা কোন কিছুর বিনিময়ে পূরন হয় না। আর বোনটির হৃদয়ে ভাইয়ের যে ছবি আঁকা থাকে সেই ছবিতে কখনোই কোন ধূলা জমে না । চিরসজীব থাকে ভাই বোনের ভালোবাসা কিংবা খুনসুটির দিনগুলোর স্মৃতি।
ভাইয়ের প্রতি বোনের এই অনুভূতি নিয়েই বেশ ক’বছর আগে নির্মিত হয়েছিল একটি বিজ্ঞাপন চিত্র। যেখানে বোনটি ছোট্ট ভাইকে হারিয়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলে। দেশ স্বাধীন হবার দীর্ঘ সময় পরেও বোনটি ছোট্ট সেই ভাইয়ের ছবিই কল্পনায় এঁকে চলে প্রতিনিয়ত। তাই তার ভাবনা জুড়ে থাকে – ‘বাবুটা বেঁচে থাকলে আজ দেখতে কেমন হতো! …. ওর কি বিয়ে হতো! …. বাবুর বাবুটা দেখতে কেমন হতো! ….’ তবে এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। ভাবনাগুলো শুধুই মনের গহীনে গুমরে মরে, অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে।
ভাই-বোন। দুইটি মাত্র শব্দ। অথচ এর মাঝে মিশে আছে ভালোবাসার এমন এক বন্ধন, যা কোন ভাষা দিয়েই প্রকাশ করা যায় না। আর এই চিরবন্ধন ছিন্ন করে কোন ভাইকে যদি চলে যেতে হয় না ফেরার দেশে, তবে সে বিচ্ছেদ বোনের জন্য প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুসম হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেক বোন হারিয়েছে স্নেহময় ভাইদের। কিন্তু ভাইয়ের রক্তের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং একটি লাল-সবুজের পতাকা প্রাপ্তি-সেই বোনদের শোককে শক্তিতে পরিণত করেছে। বোনেরা গর্বিত হয়েছে ভাইয়ের এমন মহান আত্মত্যাগে।
কিন্তু যখন স্বাধীন ভূমিতেই কোন বোন ক্ষমতা লিপ্সু বাহিনীর হাতে বিনা কারণে হারিয়ে ফেলে তার আদরের ভাইকে তা বড় অসহনীয়। তখন কোন সান্তনার বানী বোনের হৃদয়ের রক্তক্ষরণকে থামাতে পারে না। দুর্ভাগা বাংগালী জাতি দুই বোনের কাছে এমনই এক অমানবিক কর্মের জন্য লজ্জিত হয়েছে। রাজনীতির নোংরামির খেলাতে মানুষ নামের অমানুষরা বাংলার ইতিহাসে রচনা করেছে এক কালো অধ্যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র চার বছর অতিক্রান্ত না হতেই এদেশেরই কিছু দিকভ্রান্ত সামরিক সদস্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট । এর পেছনে মদদ দিয়েছে এদেশেরই বিবেকহীন কিছু রাজনীতিবিদ। ক্ষমতার লোভে এই হত্যাকারীরা এতটাই মতিভ্রম হয়ে পড়েছিল যে, শেখ পরিবারের ছোট্ট শিশু রাসেলকেও তারা রেহাই দেয়নি। হয়তো শেখ পরিবারের রাজনীতিকে সমূলে শেষ করে দিতেই শেখ রাসেলকে হত্যা করেছিল তারা।
কিন্তু এমন নির্মমতা দেখে প্রশ্ন জাগে, একটি বারের জন্যও কি তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেনি নিজেদের সন্তানদের মুখ! হত্যায় অংশ নেয়া এমন কেউ কি রাসেলের চোখে-মুখে তাদের সন্তানকে খুঁজে পায়নি! একটি বারও কি তারা চোখ তুলে তাকায়নি রাসেলের মায়াবী মুখটির প্রতি!
ক্ষমতার লোভ মানুষকে কতটা অন্ধ করে দেয় তার প্রমাণ এ হত্যাকাণ্ড। আর সে সাথে এটাও পরিস্কার হয়ে যায় ক্ষমতার কাছে মানবীয় যে কোন সম্পর্ক এভাবেই হেয় হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বাবা, ফজিলাতুননেসার মতো মমতাময়ী মা, শেখ কামাল,শেখ জামাল,শেখ রাসেলসহ বেশ কয়েকজন আত্মীয়-পরিজনকে হারানোর বিষাদ বেদনাকে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহেনা। আর আজও তাঁরা যে শোক যন্ত্রণায় মূহ্যমান তা তাদের জীবনের কোন প্রাপ্তিতেও মুছে যাবে না।
উজ্জ্বল দীপ্তময় চোখ আর মায়াবী মুখের শেখ রাসেলের জন্ম ঢাকায়, ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর। বাবা ভক্ত রাসেল সুযোগ পেলেই বাবার পাশেপাশে থাকতো। রাজনীতির কারণে অন্যান্য সন্তানকে সময় দিতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। সে কারনে তিনি সব সময় চেষ্টা করতেন রাসেলকে নিজের কাছাকাছি রাখতে। তাই স্বাধীন দেশের যে কোন সরকারী সফরেই বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকত রাসেল। রাসেলের আরেকটি সঙ্গী ছিলো তার প্রিয় সাইকেলটি। ১৯৭৫ সালে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুল, ঢাকা’র চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিল রাসেল।
ছোট্ট শেখ রাসেল বড় দুই বোনের অনেক আদরের ভাই ছিল। এ জন্যই জীবনের অন্তিম মুহূর্তে রাসেল হত্যাকারীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রিয় বোনের কাছেই যেতে চেয়েছিল বারবার । হয়তোবা ছোট শিশুটি তখন ভাবছিলো, আজ হাসু আপা থাকলে তাকে যেমন করে হোক বাচাঁনোর চেষ্টা করতো।
ডঃ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর `Some events involving Sheikh Mujib and Bangladesh` বইতে শেখ রাসেল সর্ম্পকে লিখেছেন,
‘…. রাসেল লোকজনের মধ্যে আশ্রয় নেয়ার জন্য দৌড়ে নিচে চলে যায়। হত্যাকারীরা রাসেলকে সেখানে দেখতে পেয়ে ওর দিকে রাইফেল তাক করে। আবদুর রহমান রোমা নামের যে লোকটি অনেক বছর ধরে রাসেলের দেখাশোনা করছিল, সে তা দেখতে পেয়ে ওর হাত ধরে। কিছুক্ষণ পর একজন লোক রাসেলকে রোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। রাসেল জীবনের এমন নিমর্মতাকে দেখে কান্না শুরু করে। বারবার ঘাতকদের বলতে থাকে, “আল্লাহর দোহাই লাগে, আমাকে মারবেন না। আমার হাসু আপা (শেখ হাসিনা) আর দুলাভাই জার্মানিতে থাকে। আপনারা দয়া করে হাসু আপার কাছে আমাকে পাঠিয়ে দিন”। রাসেলের কান্নায় আবেগতাড়িত হয়ে ওই সৈনিকটি তাকে বাড়ীর মূল ফটকের দারোয়ানদের ঘরে লুকিয়ে রাখে। প্রায় আধঘন্টা পর একজন মেজর রাসেলকে সেখানে লুকিয়ে থাকতে দেখে তাকে উপরে মায়ের ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে রাসেলের মাথায় রিভলভার দিয়ে গুলি করে হত্যা করে।’
চির বিদায়ের মুহূর্তে ভাইটি বোনের কাছে আসতে চেয়েছিল। বোনের নাম ধরে কাঁদছিল। কিন্তু বোনটি তখন সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে স্বামীর সংসারে আর এপারে বোনের অলক্ষ্যেই চক্রান্তকারীরা হত্যা করে ভাইটিকে। সেই ছোট্ট ভাইয়ের আকুল কান্না আর আকুতি ভরা মায়াবী চোখ যখন কোন বোনের মনে পড়ে সে কোনভাবে আবেগকে সংবরন করতে পারে।
রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে একটি বারও যদি বোনের স্থানে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা আর শেখ রেহেনার ভাই হারানোর যন্ত্রণাকে উপলদ্ধি করা যায়, তবে যুবক দুটি ভাই আর ছোট্ট রাসেলকে হারানোর কষ্টটা বোধ করি যে কোন মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়ে যায়।
হানাহানিতে মানুষ হয়ত ক্ষমতার আস্বাদ নিতে পারে। কিন্তু তাতে মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে যায়। আর মনুষ্যত্ববোধহীনদের জায়গা কোথাও হয় না। তাই তো ঘাতকরা দুই বোনের জীবন থেকে রাসেলকে ছিনিয়ে নিলেও এদেশের মানুষের কাছে সেই ঘাতকরা ও তাদের পরিবাররা ঘৃনিত থাকবে আজীবন । বাংলার মাটিতে আইন মোতাবেক ১৫ আগষ্ট হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে। রাসেলের হাসু আপা খুনীদের সাজা দিয়ে তার কথা রেখেছে। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া ভাইকে আর ফিরে না পাওয়ার অবর্ননীয় কষ্ট প্রতিনিয়ত বোনকে কুরেকুরে খায়। কোন সান্তনাই বোনের অবুঝ হৃদয়ে প্রবোধ মানে না এটাই সত্য।
প্রতিবছরই বাংলাদেশের মানুষ ১৫ই আগষ্ট পালন করে ‘শোক দিবস’ হিসাবে। কিন্তু বোনদের ভাই হারানোর যন্ত্রণা প্রশমিত হয় না কখনোই; বরং তা আরো তীব্র আকার ধারণ করে হারিয়ে যাওয়া সেই ছোট্ট ভাইটির মতো অন্য কোন ভাইকে দেখলে। আজ যদি ছোট্ট রাসেল বেঁচে থাকতো তবে এখন সে ৫৫ বছর বয়সের এক পরিপূর্ণ পুরুষ হতো।
বেঁচে থাকলে রাসেল কার মতো হতো? বাবা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের গাম্ভীর্য পেত? নাকি অন্য দুই ভাইয়ের মতো উচ্ছ্বল-উচ্ছাসে ভরপুর হতো? এখনও কি রাসেল প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ছুটে আসতো হাসু আপার কাছে? আদর কেড়ে নিতে অথবা নানা আবদারে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতো হাসু আপাকে? মনে প্রশ্ন আসে অসংখ্য কিন্তু কোন উত্তর মেলে না। রাসেল বড় হয়ে কেমন হবে সেটা দুই বোনের কাছে একসময় ছিল সুখময় কল্পনা; কিন্তু সেই কল্পনাই এক ভোরে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। যে দুঃস্বপ্ন আজো দুই বোনকে তাড়া করে বেড়ায়। আর নিয়তির নির্মম পরিহাস, আজীবন এই দুঃস্বপ্নকে বয়ে বেড়াতে হবে বোনদেরকে।
যে ভাইটি হাসু আপা বলতে ছিল অজ্ঞান সেই ভাই-ই যখন চিরতরে হারিয়ে যায়, তখন বোনের কাছে এ কষ্টের চেয়ে অসহনীয় আর কিছু নেই। তবুও কঠিন সেই বাস্তবতাকেই মেনে নিতে হচ্ছে দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে । উনার জীবনের কঠিন বাস্তবতা হলো, মায়াবী চোখের পরিপূর্ন এক পুরুষরূপে ছোট্ট ভাই রাসেলকে দেখার আকাঙ্খা পূরন হবে না কোনদিনই।
এ নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই ছোট্ট শিশুরটি প্রতি শ্রদ্ধায় বাঙ্গালী জাতির মাথা নুয়ে আসে। চোখে ঝরে জল আর অন্তর থেকে ঘাতকদের প্রতি বর্ষিত হয় ধিক্কার। আর বোনটি ভাই হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করেছে।
বাবার আদর্শে বলীয়ান হয়ে, বাবার মতোই ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছেন বাংলার মানুষকে। নিজের জীবনের মায়া ভুলে তিনি দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত বংগবন্ধুর যোগ্য কন্যা হিসেবে। আর এভাবেই ছোট্ট রাসেলকে হাসু আপা আগলে রেখেছেন তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)