চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ছেলেটির জীবনে দ্বিতীয় চুমুর আগেই পুলিশের গুলিতে মৃত্যু

ছেলেটি প্রথম চুমু খেয়েছিলো দুই বছর আগে। ২০১৩ সালের ২৫ মার্চ প্রথম চুমুর কথা সে জানিয়েছিলো তার ফেসবুকে। পৃথিবীর মধুরতম এ অনুভূতি একান্তই নিজের হলেও আনন্দটা সে লুকিয়ে রাখতে পারেনি। বন্ধুদের সে আজান দিয়েই সেটা জানিয়েছিলো। তবে বয়স কম হলেও এটুকু বোধবুদ্ধি ছিলো যে যার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে মধুরতম অনুভূতি সেই মানুষটার পরিচয় জানানো যাবে না।

অামরা জানি না ওই মেয়েটিকে সে আর দ্বিতীয় কোনো চুমু খেতে পেরেছিলো কিনা, কিংবা অন্য কোনো মেয়েকে। ছেলেটি আর কখনও কাউকে চুমু খাবে না, কোনো মেয়েকে না; এমনকি তার মা-বোন-ভাই-বাবাকেও না। বরং তাদের শেষ চুমুতে সিক্ত হয়ে ছেলেটি এখন মৃত্তিকার কোলে। একটি জীবন শুরু হওয়ার আগেই থেমে গেছে। থামিয়ে দিয়েছে এই রাষ্ট্রের পুলিশ, পুলিশের গুলি।

গত শুক্রবার টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে নারীর লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে যে জনরোষের মিছিলে পুলিশ গুলি চালায় তাতে মাথায় ও বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিলো রুবেল ইসলাম। রোববার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হলে ওই ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় চারে।

এই বাচ্চা ছেলেটির এরকম মৃত্যুতে শুধু পুলিশের বিরুদ্ধেই যে চরম মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তা নয়, হাসপাতালের বিরুদ্ধেও অমানবিকতার অভিযোগ উঠেছে। ছেলের চিকিৎসায় উদাসীনতার অভিযোগ এনেছেন রুবেলের বাবা ফারুক হোসেন।

চ্যানেল আই অনলাইন প্রতিবেদকের সঙ্গে রুবেলের মৃত্যুর আধাঘণ্টা আগেও তার বাবা ফারুক হোসেনের কথা হয়। তখন তিনি অভিযোগ করে বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের ১২ নম্বর বেডে ডা. রেজাউল করিমের তত্ত্বাবধানে ভর্তি তার ছেলে। কিন্তু গত ২৪ ঘন্টায়ও ডা. রেজাউলের দেখা মেলেনি। নার্সরা মাঝেমধ্যে স্যালাইন আর ব্যথার ওষুধ দিয়ে চলে যায়। এখন পর্যন্তও অপারেশনও করে নাই।

সন্তানের মুমূর্ষু অবস্থার বর্ণনায় ফারুক হোসেন বলেছিলেন: শুক্রবার রাতে ভর্তি করেছি। মাথায় ও বুকে গুলি লেগেছে। কষ্টে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতাছে। জ্ঞান ফিরে নাই ওর। চোখের সামনে চিকিৎসার অভাবে ছেলেডা মইরা যাইতাছে।

ছেলেকে বাঁচানোর আকুল আকুতি জানিয়ে তিনি বলেছিলেন: আমার আদরের বড় পোলা। এখানে আমারে কেউ একটা ডাক্তারের ব্যবস্থা কইরা দেন। ভিটে-মাটি বেইচ্যা হইলেও চিকিৎসা করামু। চোখরে সামনে পোলাডা মইরা যাইতাছে।

কিন্তু পিতার প্রাণান্ত চেষ্টা, আকুল আকুতি সবই ব্যর্থ হয়ে যায় রোববার সন্ধ্যায়।

শনিবার সকাল সাড়ে ৮টায় রুবেলের অপারেশন হওয়ার কথা ছিল। বাড়ি থেকে টাকা যোগাড় করে রাস্তায় যানজট থাকায় ঢাকা পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় ওইদিন আর তার অপারেশন হয়নি। এরপর থেকে কোনো ডাক্তার আর তাকে দেখতে আসেনি বলে অভিযোগ রুবেলের বাবার।

বাবা ফারুক হোসেন ও মা রূপসী বেগমের তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে রুবেল ছিলো সবার বড়। পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে বিদেশ পাঠানোর ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু বিদেশের কথা শুনলেই ভয় পেতো সে। তার কারণ হয়তো অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া অনেক মানুষের কষ্টের জীবন কিংবা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তার খোঁজ-খবর জানা।

তার ফেসবুক পেজে প্রবাসীদের কষ্ট নিয়ে গান আছে। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে একাধিক শেয়ার আছে যেখানে ফুটে উঠেছে অভিবাসনপ্রত্যাশী শরণার্থীদের অমানবিক জীবনের কথা। বিদেশ মানে যদি এরকম ঝুঁকিপূর্ণ কিছু হয় ভেবেই হয়তো বিদেশের নাম শুনলেই ভয় পেতো রুবেল ইসলাম। তাই সে বিদেশে যেতে রাজি ছিলো না। এখনতো মনে হয় বিদেশে চলে গেলেই বেঁচে যেতো সে। এমনকি অবৈধভাবে কোনো সীমান্ত অতিক্রম করার সময় কোনো সীমান্তরক্ষীর গুলিতে নিহত হলেও একটা সান্ত্বনা থাকতো। এখন যখন নিজের গ্রামে নিজ দেশের পুলিশের গুলিতে সে নিহত হলো তখন তার উত্তর কী!

ছোট-বড় প্রত্যেকটি মানুষই একেকজন আলাদা মানুষ, রুবেল হোসেনও তাই। একটি ১৮ বছর বয়সী মানুষের যেরকম হওয়ার কথা সেরকমই ছিলো রুবেল ইসলাম। আঠারো বছর বয়সী একটা ছেলের মধ্যে অচেনা নারীকে চেনার যেমন আকুলতা থাকার কথা সেটা রুবেলের মধ্যেও ছিলো। তার প্রথম চুমুর কথা যেমন সে সকলকে জানিয়েছে, তেমনই অজানা কারণে নারী বিদ্বেষের কথাও লুকিয়ে রাখেনি। আবার কোনো এক বালিকার জন্য তার ভেতর এক হাহাকারও ছিলো সবসময়।

‘কষ্ট ভরা মন নিয়ে আজো তোমার অপেক্ষায়,’ এরকমই একদিন লিখেছে সে। অন্যদিন লিখেছে: তোর নাম ঠোঁটে সাজিয়েছি আমি, তোর ছায়া মনে বসিয়েছি আমি। এই পৃথিবী তোকে খুঁজতে পাগল হয়ে যাবে, মনের এমন জায়গায় তোকে লুকিয়ে রেখেছি আমি! আরেকদিন সে লিখেছে: যাকে দেখলে সব কষ্ট ভোলা যায়, যাকে দেখলে শান্তি পাওয়া যায়, সে কেন কষ্ট দেয়।

তার একদিনের পোস্ট এরকম: এক নিস্তব্ধ রাত্রিতে, এক নিকষ অন্ধকারে, এক গভীর ঘুমে, এক সুন্দর স্বপ্নে এক প্রিয় বন্ধুকে জানাই ‘শুভরাত্রি’। সেখানে সে আবার একটি গ্রাফিক্স দিয়েছে যেখানে লেখা: যদি চোখে রাখো চোখ, মনে রাখো মন, তবে বলছি তোমায় ভালোবেসে যাবো সারাজীবন, তুমি কথা দাও সত্যি বলছি, কোনোদিন তোমায় দিবো না ব্যথা।

আরেকদিন আরেকটা গ্রাফিক্স শেয়ার করেছে সে যাতে ইংরেজিতে লেখা: আই মিস ইওর কাডলস, আই মিস ইওর কিসেস, বাট মোস্ট অব অল আই মিস ইউ। দ্যা লাভ আই হ্যাভ উইল নেভার চেঞ্জ, এজ ইচ ডে গোজ বাই, আই উইল লাভ ইউ টিল দ্যা ডে ডাই।

আমরা জানি না গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত রুবেল যখন জীবন্মৃত অবস্থায় ছিলো তখন সেই মুখ তার মধ্যে ভেসে উঠেছিলো কিনা, কিংবা তার মা-বাবা। অথবা মাদ্রাসাপড়ুয়া যে ভাইয়ের ছবি সে শেষ যেদিন (১২ সেপ্টেম্বর) ফেসবুকে বসেছিলো সেদিন শেয়ার করেছিলো তার মুখ অথবা ফেসবুকে আগে শেয়ার করা এক দেড় বছর বয়সী তার কাজিনরা যাদের ছবি দিয়ে সে বারবার বলেছে, এই শিশুদের কতোটা ভালোবোসে সে।

এই বয়সে যেমন হয়, ধর্মের প্রতিও রুবেল ইসলাম তার ভালোবাসা ফুটিয়ে তুলেছে ফেসবুকে। মক্কার ক্রেন দুর্ঘটনার পর তার একাধিক শেয়ার দেখছি যেখানে সে নিহতদের জন্য দোয়া চেয়েছে। অচেনা-অজানা মানুষের জন্য সে দোয়া চেয়েছে, অথচ তার জন্য আশির্বাদের বদলে অভিশাপ হয়ে আসলো তার নিজের রাষ্ট্র।

ইসলামের নানাদিক শেয়ার করার পাশাপাশি প্রযুক্তি এবং খেলাধূলা নিয়েও অনেক পোস্ট দেখছি তার। বোঝাই যায় তার বয়সী যে কোনো কিশোরের মতো ক্রিকেটই ছিলো তার ধ্যানজ্ঞান। টাইগারদের অর্জনে বারবার গৌরবের কথা লিখেছে সে। আবার কোনো মেয়ের কাছে হয়তো কষ্ট পাওয়ার কারণে মেয়ে মানেই কষ্টের কারণ লেখার পাশাপাশি বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের অর্জনও বাদ যায়নি তার পোস্ট থেকে যেমন বাদ পড়েনি মজার মজার অনেক ভিডিও।

আবার এমন অনেক ভিডিও সে শেয়ার করেছে যেখানে মনুষ্যত্বের কথা বলা হয়। এরকম একটি ভিডিও দিয়ে সে লিখেছে: দয়া করে সবাইকে ভিডিওটা দেখার অনুরোধ রইলো, মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

শুধু ওই দায়িত্ববোধ থেকেই হয়তো সেদিন সে এক মায়ের লাঞ্ছনার প্রতিবাদে মিছিলে গিয়েছিলো। আর তাতেই এখন তার মা-বাবার বুক খালি। অথচ একদিন একটি নিখোঁজ সংবাদ শেয়ার করে রুবেল হোসেন লিখেছিলো: শেয়ার করে সবাইকে জানিয়ে দিন। আপনার একটা শেয়ারে হয়তো মা বাবার বুক খালি হবে না।

তবে গুলিতে তার বুক বিদীর্ণ হওয়ার সপ্তাহখানেক আগেই তার হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছিলো। ১০ সেপ্টেম্বর একটি পোস্টে সে এক বন্ধুর ছবি দিয়ে সেই খবরটি জানিয়েছে এভাবে: এই সেই আমাদের বন্ধু রবিন (রাজু)। যার সাথে অনেক সময় পার করেছি। আর আমাদের সাথে ও সবসময় হাশিখুশি হয়ে থাকত। এই বন্ধু আর কোনো দিন আমাদের কাছে আসবে না। কারণ সে এখন থেকে এক ঘন্টা আগে মটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন সে যেনো বেহেশতবাসী হয়।

ছেলেটির কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিলো কি না জানি না। তবে প্রবল ধর্মবিশ্বাসী ছেলেটি মৃত্যুর সপ্তাখানেক আগে একরাতে ফেসবুকে গুডনাইট জানিয়েছিলো একথা লিখে: বন্ধুরা আল্লাহ হায়াত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখলে আবার কালকে দেখা হবে।

আল্লাহ তাকে যতোদিনের হায়াতই দিয়ে থাকুন না কেনো, বাচ্চা ছেলেটিকে মেরে ফেলেছে পুলিশ।

ভয়ংকর অনেক বিষয় সে যেমন তার ফেসবুক পেজে শেয়ার করেছে তেমনই মজার মজার অনেক কার্টুন। অনেকগুলো ছবি আছে প্রকৃতিকে নিয়ে। এরকম একটি ছবি দিয়ে রুবেল লিখেছিলো: এই সেই পার্ক যেখানে সুখ, দুঃখ নিয়ে প্রতিদিন বিকেলে বন্ধুরা মিলে চলে আসতাম আর আজ সেই…… ১।বক্কর। ২।বেল্লাল। ৩।জহিরুল। ৪।প্রদীপ। ৫।ফাহাদ। ৬।সাজু। ৭।নুরুজ্জামান বন্ধুরা নেই আর এই পার্কেও আসা হয় না। মিস ইউ বন্ধুরা। জানি না আবার কতোদিন পরে তোমাদের সাথে একসাথে হতে পারবো কি পারবো না। তো তোমরা যে যেখানেই আছো ভালো থেকো।

তার এই বন্ধুরা হয়তো ভালো থাকবে অথবা থাকবে না। কিন্তু সারাজীবন নিশ্চয়ই তাদের মনে হবে তাদের একটি বন্ধুকে মেরে ফেলা হয়েছে যখন তার বয়স ছিলো মাত্র ১৮।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)