পরনে ছেঁড়া শাড়ি। জীর্ণ-শীর্ণ শরীর। চোখে-মুখে রোগের ছাপ স্পষ্ট। অসুখে নুয়ে পড়া শরীর নিয়ে ঢেঁকিতে ধান ভানছেন এক গৃহস্থের বাড়িতে। নিজের বলতে কিছু নেই। অন্যের বাসায় কাজ করে যে ক’টি টাকা বা চাল পান তা দিয়েই চলে তার সংসার।
১৯৯৫ সালে এভাবেই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের সাহসীযোদ্ধা তারামন বিবি বীর প্রতীককে দেখতে পান সেসময় দৈনিক ভোরের কাগজে কর্মরত কুড়িগ্রামের সাংবাদিক পরিমল মজুমদার।
দেশের স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার যখন তারামন বিবিকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়। তখনো কেউ সন্ধান জানত না তার।
স্বাধীতার পর প্রায় দীর্ঘ দুই যুগ পর্যন্ত তারামন বিবির পরিচয়টা সবার কাছে ছিল অজানা। পরে ১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাসে খোঁজ মেলে এ বীর প্রতীকের। তাকে খুঁজে বের করেন ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিমল কান্তি দে।
তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একজন গবেষক। বিমল কান্তি দে কুড়িগ্রামের রাজীবপুর ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক আব্দুস সবুর ফারুকীর কাছে তারামন বিবির সন্ধান চান। সেসময় পরিমল মজুমদার যক্ষা রোগে আক্রান্ত তারামন বিবিকে পান উলিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে চিকিৎসা নিতে গেয়েছিলেন তিনি।
সেদিন সাংবাদিক পরিমল মজুমদার তারামন বিবির প্রথম সাক্ষাৎকার নেন। দিন চারেক পর সেই সাক্ষাৎকার বলতে গেলে গুরুত্বহীনভাবে ভোরের কাগজের মফস্বল পাতায় ছাপা হয়।
পরবর্তীতে সেই সংবাদের ভিত্তিতে নারীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘প্রবর্তনা’ তারামন বিবিকে ঢাকায় এনে সংবর্ধনা দেন। ওই বছরই ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকায় গণভবনে নিয়ে তারামন বিবির হাতে তুলে দেয়া হয় সম্মাননা পদক। এ কাজে সেসময় বিবিসিতে কর্মরত সাংবাদিক আতাউস সামাদের অবদান উল্লেখযোগ্য।
বর্তমানে মাছরাঙা টিভিতে কর্মরত সাংবাদিক পরিমল মজুমদার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ভোরের কাগজ সেসময় তারামন বিবির জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়। সেখানে আড়াইলাখ টাকার মত জমা হওয়ার পর সেই টাকা দিয়ে তাকে রাজীবপুরের মাস্টপারপাড়ায় থাকার একটি ঘর ও চাষাবাদের জন্য কিছু জমি কিনে দেয়া হয়। একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় তারামন বিবির বাড়িটি তৈরী করা হয়।
খাওয়া-পরার ব্যবস্থা হলেও অসুস্থতা পিছু ছাড়েনি এ বীর প্রতীকের। যক্ষা ভালো হলেও তীব্র শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগতেন তিনি। সিওপিডি নামক জটিল দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের সংক্রমণ রোগে ভুগছিলেন। যে কারণে নিঃশ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হতো তার।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তারামন বিবি। মৃত্যুর ১০ থেকে ১২ দিন আগে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে হেলিকপ্টারে করে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে আসা হয় তাকে। সেখান থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে দিন চারেক আগে নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের এ বীর সেনানী শুক্রবার দিবাগত রাতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলা সদরের নিজ বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে বক্ষব্যাধিসহ নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবির সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মৃত্যুকালে তারামন বিবির বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।
তারামন বিবি ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রাম জেলার রাজীবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুস সোহবান এবং মায়ের নাম কুলসুম বিবি। তিনি মাত্র ১৩ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন তারামন বিবি। সেসময় মুক্তিবাহিনীর রান্নাবান্না, তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখা, পাকবাহিনীদের খবরাখবর সংগ্রহের কাজও করেছেন তিনি।
সেসময় নদী সাঁতরে চলে যেতেন পাকসেনাদের ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে মুখে চোখে কালি লেপন করে, চুলে ময়লা মেখে চলে যেত পাকসেনাদের ক্যাম্পে। ক্যাম্পের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতেন। পাগল ভেবে সেসময় পাকসেনাদের কেউ তাকে ঘাঁটাতো না। আর সেই সুযোগে পাকসেনাদের অবস্থান, সংখ্যা, অস্ত্রের খোঁজ-খবর নিত সেই ছোট্ট কিশোরীটি। এমনকি মাঝে মধ্যে যুদ্ধেও তাকে নিয়ে যাওয়া হতো।
তারামন বিবি সম্মুখ যুদ্ধে পাকবাহিনীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে ১৯৭৩ সালে বীর প্রতীক খেতাব অর্জন করেন।
খোঁজ পাওয়ার পর ১৯৯৫ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবিকে বীরত্বের পুরস্কার তার হাতে তুলে দেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে যে দু’জন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম তারামন বিবি। আরেক নারী বীরপ্রতীক কাঁকন বিবিও চলতি বছরের ২১ মার্চ ইন্তেকাল করেন।