চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘বড় কষ্ট কইরা সোনার বাংলা স্বাধীন করেছি’

গত বছরের ২৫ মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মুক্তিসংগ্রাম নাট্যোৎসব-২০১৭’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তারামন বিবি বীর প্রতীককে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়

সেই সম্মাননা অনুষ্ঠান শেষে বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত এ নারী মুক্তিযোদ্ধা এক বিশেষ সাক্ষাৎকার দেয় চ্যানেল আই অনলাইনকে। ওই সাক্ষাৎকারে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে তার কথোপকথন তুলে ধরা হলো।

তারামন বিবি: ‘‘আমরা যদি দেশ স্বাধীন না করতাম তাহলে আজ আমাদের অমানুষদের পাশে থাকতে হতো। তারা (পাকিস্তান হানাদার বাহিনী) আমাদের মানুষ বলে মনে করত না। দেশের এই বিজয় ভাইসা আসে নাই, এমনি এমনি আসে নাই। বড় কষ্ট কইরা এই বিজয় এনেছি। অনেক কষ্ট করে সোনার বাংলা স্বাধীন করেছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘২৫ শে মার্চ রাতের গণহত্যার ভয়াবহতা বুঝেই আমরা যুদ্ধে নেমেছিলাম। প্রথমে একটি ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতাম। এরপর আস্তে আস্তে অস্ত্র চালানো শিখি। এভাবেই পাক হানাদার বাহিনীকে এ দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলাম।’

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তারামন বিবি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামের একজন কিশোরী আমি। গ্রামের মেয়ে হিসেবে যেই সময়টাতে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো, সেই সময়টা কাটিয়েছি ভয় আর শঙ্কা নিয়ে। পাকিস্তানি নির্লজ্জ হায়েনাদের কথা মনে পড়লে এখনও আমার গা ঘেন্নায় রি রি করে ওঠে।’

‘‘সে সময় দেশে শুরু হলো তোলপাড়। মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে যার যার মত করে। কে, কোথায় যাবে, কোন ঠিকানা খুঁজবে জানা নেই। তখন আমরাও চলে যাই রাজীবপুরের আরেক ইউনিয়ন কোদালকাঠিতে।

যাদের দেখলে সবাই ভয়ে পালিয়ে বেড়াতো, সেই ভয়ের জায়গায় আমি শশরীরে যুদ্ধ করেছি।’’

যুদ্ধের প্রত্যাশা, প্রাপ্তি আর বর্তমান বাংলাদেশকে নিয়ে এই বীর যোদ্ধা বলেন, ‘সাধারণ মানুষও দেখতাছে, আমিও দেখতাছি দেশটা আগের চেয়ে এখন অনেক শান্তিতে আছে, দেশ অনেক আগাইছে। সবাই অনেক সুখে শান্তিতে দেশে বসবাস করছে।’

মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী, খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি বীরপ্রতীক শুক্রবার দিবাগত রাতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলা সদরের নিজ বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে বক্ষব্যাধিসহ নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবির সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মৃত্যুকালে তারামন বিবির বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।

তারামন বিবি ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রাম জেলার রাজীবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুস সোহবান এবং মায়ের নাম কুলসুম বিবি। তিনি মাত্র ১৩ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন তারামন বিবি। সেসময় মুক্তিবাহিনীর রান্নাবান্না, তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখা, পাকবাহিনীদের খবরাখবর সংগ্রহের কাজও করেছেন তিনি।

তারামন বিবি সম্মুখ যুদ্ধে পাকবাহিনীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বীর প্রতীক খেতাব অর্জন করেন।

১৯৭৩ সালে তারামন বিবির সাহসীকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তবে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে কেউ খুঁজে বের করতে পারেনি।

যুদ্ধের প্রায় দুই যুগ পর ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক বিমল কান্তি দে তার সন্ধান পান। তথ্য দিয়ে তাকে সহায়তা করেন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী।

১৯৯৫ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবিকে বীরত্বের পুরস্কার তার হাতে তুলে দেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে যে দু’জন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম তারামন বিবি। আরেক নারী বীরপ্রতীক কাঁকন বিবিও চলতি বছরের ২১ মার্চ ইন্তেকাল করেন।