আমার বাল্যকালের স্মৃতিতে ওই সময়ের, পঞ্চাশের দশকের দিকে ঢাকার তেজগাঁও ডেইরি ফার্মের সরকারি বাসায় আমার বাবার হাতে তৈরি কিচেন গার্ডেনটি উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। এর পরে আমরা আমার বাবার চাকরির সুবাদে যেখানেই গিয়েছি সেখানেই কিচেন গার্ডেন বলে পরিচিত সবজি এবং কোথাও হাঁস-মুরগি পালনের সাথে জড়িত থাকতাম।
ওই সময়ে এবং আরও পরে মধ্যবিত্ত সরকারি চাকুরে অথবা সাধারণ মানুষের মধ্যে কিচেন গার্ডেন বা শখের থেকে সংসারের অনেকটা প্রয়োজন মিটাতে এ ধরণের কৃষি দেখেছি। কিন্তু কালের বিবর্তনে এবং নগরায়ন ও আধুনিক জীবন ধারণ করতে গিয়ে আমরা বোধ হয় আমাদের দেশের এই সংস্কৃতিটি ভুলতে বসেছিলাম বা ক্ষেত্র বিশেষে ভুলে গিয়েছি।
সামরিক বাহিনীতে চাকুরির সুবাদে বোধ হয় বনে জঙ্গলে অনেক সময় কাটাতে হয় বলে গাছ লাগানো, গাছের পরিচর্যার প্রতি ঝোঁক ছিল। তা ছাড়া সেনা ছাউনিগুলোতে প্রতি বছর আনুষ্ঠানিকভাবে গাছ লাগানো হয়ে থাকে। কিন্তু অর্থকরী বা ফলফলাদির গাছের সাথে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় তরকারির বাগান করবার অনুপ্রেরণা পেতে শুরু করি যখন আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘মাটি ও মানুষ’ নামে একটি অনুষ্ঠান দেখে। ওই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন একজন তরুণ উপস্থাপক, যিনি এখন এক নামে পরিচিত, চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ।
আজ তিনি দেশের, বিশেষ করে কৃষক হতে গ্রাম ও শহরের মধ্যবিত্তসহ সমাজের সবার কাছে পরিচিত ও সম্মানের পাত্র। এটা তাকে ওই সময় হতে অর্জন করতে হয়েছে।
সে সময় বিটিভির ওই প্রোগ্রাম আমার চেয়ে আমার মিসেস বেশি দেখতেন। তরুণ শাইখ সিরাজ মাঠে ঘাটে কৃষকদের সাথে সময় কাটাতেন বেশি। পরামর্শ দিতেন নানান ফলফলাদির গাছ লাগানোর ও পরিচর্যার। অনুষ্ঠান দেখে দেখে ক্রমেই আমিও আসক্ত হতে শুরু করলাম। অনুপ্রাণিত হলাম। আমি তখন তৎকালিন বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর এর খুলনার সেক্টর কমান্ডার। শহরের অস্থায়ী সেক্টর সদর। নতুন সদর দফতর তৈরি করার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হলেও খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (তখন কমিশনার প্রধান ছিলেন) সাথে বাইপাস সড়ক নির্মাণের জন্য ওই জায়গার সীমানা নিয়ে বিবাদ থাকার কারণে কাজ শুরু করা যায়নি। জায়গাটি একটু নিচু ভূমি ছিল।
তৎকালিন বিডিআর প্রধান জেনারেল আতিকুর রহমানের অনুমতি সাপেক্ষে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে একটি শর্তে জায়গা দেয়া হয়েছিল যে, তাদের রাস্তার মাটি সেক্টর হেডকোয়ার্টারে তিনদিকে খালখনন করে নিতে হবে। খালটি আমার পরিকল্পনায় হয়েছিলো। মাঝখানের পরিত্যক্ত মজাপুকুরটি সংস্কার করা হল। বিটিভির ‘মাটি ও মানুষ’ আর তরুণ উপস্থাপক শাইখ সিরাজ আমার চিন্তাধারার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। পুকুর ও খালে ব্যাপক মাছের চাষের ব্যবস্থা করা হল আর খালের পাড়ে উন্নত জাতের নারকেল গাছ লাগানো হল। অবশ্য সরকারি মৎস্য ও হর্টিকালচার বিভাগ উপকরণ ও পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিল। এই প্রজেক্টে যাদের তদারকিতে রাখা হয়েছিল তাদের কাজ ছিল বিটিভিতে ‘মাটি ও মানুষ’ দেখা ও অনুপ্রাণিত হওয়া।
বছরখানেকের মধ্যে মাছ থেকে ভালো আয় হতে শুরু করেছিল। সেক্টরের বিল্ডিংগুলো না হওয়া পর্যন্ত ‘কিচেন গার্ডেন’ হতে প্রায়ই শাক-সবজি সেক্টরের সৈনিকদের রন্ধনশালায় যেত। এখানেই শেষ হয়নি ওই সেক্টরের প্রতিটি বিওপিতে ‘কিচেন গার্ডেন’ গড়ে তোলা হয়েছিল, যার রেওয়াজ এখনও রয়েছে। বহুবার ভেবেছিলাম শাইখ সিরাজ নামের সেই তরুণকে আমন্ত্রণ জানাই, কিন্তু হয়ে ওঠেনি।
তারপরে দুই যুগের অধিক পরে শাইখ সিরাজের সাথে আমার ঘনিষ্ট পরিচয় চ্যানেল আই-এর সুবাদে। তখন শাইখ সিরাজ বিটিভির সেই জনপ্রিয়তা উচ্চমাত্রায় নিয়ে গেলেন চ্যানেল আইয়ে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ নামের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগাতে লাগলেন। সামাজিক বিবর্তনের সাথে নিজের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনলেন। সোজা-সাপ্টা কথায় বললে বলা যায় শাইখ সিরাজ নগরকৃষি, যা আজ ‘ছাদকৃষি’ নামে অধিক পরিচিত, তার একক উদ্যোক্তা।
এর মধ্যে আমার বিটিভির ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান আর দেখা হয়নি। কারণ অনুষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শাইখ সিরাজের সাথে পরিচিত হওয়া না পর্যন্ত তার চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। আমাদের পরিচয় বন্ধুত্বে পরিণত হল। একই সাথে আমি নতুনভাবে শাইখ সিরাজের অদ্ভুত উদ্ভাবনী শক্তির আবহে পুনরায় প্রভাবিত হলাম। এবার শাইখ সিরাজের মাঠের কৃষকদের সাথে যুক্ত করলেন নগরকৃষকদের। এক ধরণের বিপ্লব আনলেন নগরের মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যে ‘ছাদকৃষি’ ছড়িয়ে দিয়ে। কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকা মহানগরীর ইট কংক্রিটের বহুতল বাড়ির ছাদে মিলল সবুজের দেখা। ছাদকৃষি হয়ে উঠল নগরায়নের নতুন উদ্ভাবন।
আমিও ছাদকৃষির সাথে যুক্ত হলাম, আমার পুনঃনির্মিত বহুতল বাড়ির ছাদে সবুজায়নের প্রয়াস নিলাম। আমার অবসর জীবনের অন্যতম প্রধান ব্যাস্ততা। প্রায় ৩ বছরে ছোট পরিসরে ছাদে একখ- সবুজ ফল-ফসলের বাগান গড়ে তুলেছি। এর পেছনের প্রেক্ষাপট আমার বন্ধু শাইখ সিরাজ। তাকে আমন্ত্রণ জানালাম আমার ছাদে। শাইখ সিরাজের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ ও ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষের ডাক’ আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও প্রশংসিত অনুষ্ঠান। আমার ক্ষুদ্র প্রয়াসও স্থান পেল তার অনুষ্ঠানে। আমার বাগানের প্রতিবেদন টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার পর এলাকার অনেকেই ছাদকৃষিতে আকৃষ্ট হলেন। আমার এলাকার প্রতিটি ছাদই এখন ছোটখাট বাগান।
শাইখ সিরাজের এই অদম্য অভিযাত্রা শুধু প্রচারণা আর নগরবাসিদের উদ্বুদ্ধকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিগত দুই বছর ধরে কৃষি বিভাগ আমলে নিয়েছে শাইখ সিরাজের নিরবে ঘটিয়ে দেওয়া বিপ্লবকে। সরকার শুরু করল ‘নগরকৃষি’ উৎপাদন সহায়ক (পাইলট প্রকল্প) এর অধীন ‘ছাদকৃষি, কিচেন কম্পোস্ট ও ড্রিপ ওয়াটার ইরিগেশন প্রদর্শন’ এ প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে আমাদের এ এলাকায় (ডিওএইচ এস, মহাখালী) বেশ কয়েকটি নির্বাচিত বাড়িকে নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে এ বছরের প্রকল্পে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াসের ছাদবাগানটিও রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় শুধু ছাদকৃষি উপকরণই না, পানি সেচের ব্যবস্থা, কিচেনের শাক-সবজির ফেলে দেয়া অংশগুলো ব্যবহার করে কম্পোস্ট সার বা জৈবসার তৈরির ব্যবস্থাও রয়েছে। এ সবই শাইখ সিরাজের একনিষ্ট অবদানের প্রেক্ষাপট।
এই করোনাকালে আমার প্রাতঃভ্রমণের জায়গা আমার ছোট ছাদটি। শুধু প্রাতঃভ্রমণই নয়, নির্মল বাতাস আর অক্সিজেনের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা কাটাই। ছাদের গাছগুলোতে টিয়াসহ অনেক নাম না জানা পাখির আগমন ঘটে, তাদের কিচির মিচির শুনি। এই দুর্দিনে ওই সময়টুকু আমাকে সমস্তদিনের জন্য তরতাজা রাখে। এ সময়কে আমি নাম দিয়েছি ‘কোয়ালিটি টাইম’। ফুলে ফলে ও অল্পবিস্তর সবজিতে ভরা ছাদে যখন প্রতিদিন হাঁটি মনের মাঝে একটি চেহারাই উদ্ভাসিত হয়, হৃদয়ে মাটি ও মানুষের শাইখ সিরাজ। একজন মানুষ দারুণ এক বিপ্লব ঘটিয়েছেন গ্রামে ও শহরে। অনেক আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি যখন তার অনুপ্রেরণায় একজন অটোরিকশা চালক অটোরিকশার ছাদে অতিক্ষুদ্র পরিসরেও সবুজের সমারোহ গড়েন।
শাইখ সিরাজের জন্মদিনে ধন্যবাদ জানাই তার এই মহৎ প্রয়াসের জন্য। ধন্যবাদ জানাই সরকারের কৃষি বিভাগকে, তারা এ উদ্যোগে সাড়া দিয়ে তার বিপ্লবকে সমর্থন দিয়েছেন।
শাইখ সিরাজ এখনও ছুটে বেড়ান মাটির টানে ওইসব মানুষের খোঁজে যারা বাংলাদেশের কৃষি বিপ্লব ঘটিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছেন। আর আমাদের মত নগরবাসীদের একটি অক্সিজেন ফ্যাক্টরি তৈরির হাতেখড়ি দিয়েছেন। শাইখ সিরাজের এই অদম্য শক্তি যেন অটুট থাকে, তার জন্মদিনে এই দোয়াই করি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)