নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কে না চায়? নিজের মতো চলা-ফেরা, নিজের মতো দিন কাটানো, নিজের মতো করে বাঁচার মজাই আলাদা। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর জীবনে এই সুখ নেই। বরং আছে নানা বাধানিষেধ আর বাধ্যবাধকতা।
ঠিকমতো পড়াশোনা করতে হবে, ক্লাস করতে হবে, ক্লাসে আবার অমনোযোগী হওয়া চলবে না, পাশের প্রিয় বন্ধুটির সঙ্গে ফিসফাস করা যাবে না, শিক্ষকের বিরক্তিকর কথা শুনতে হবে, হোমওয়ার্ক করতে হবে, পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষায় আবার অন্যেরটা দেখা বা নকল করা যাবে না! এসব যে কতটা একঘেয়ে ক্লান্তিকর ও বিরক্তিকর তা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন।
খেলাধুলা, আড্ডা, ফেসবুকিং, ঘুরে বেড়ানো, ঘরে শুয়ে থাকা ইত্যাদি মধুর সব প্রলোভন উপেক্ষা করে আমাদের দেশে এখনও যে শিক্ষার্থীরা ক্লাস রুমে যায়, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এজন্য তাদের অভিন্দন জানানো উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের এই ত্যাগের মূল্য কেউ তেমনভাবে বুঝতে চায় না। অভিভাবকরা না, অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরাও না। অভিভাবকদের কথা না হয় বাদ দিলাম, সব অভিভাবকের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিদ্যা-শিক্ষা সমান হয় না। এ ছাড়া তারা নানা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
সবচেয়ে বড় কথা তাদের পরিবার সামলাতে হয়। পরিবার সামলানো আর রাষ্ট্র সামলানো প্রায় একই কথা। পরিবার তো রাষ্ট্রেরই একটি ক্ষুদ্ররূপ। কিন্তু শিক্ষকরাও যখন শিক্ষার্থীদের দুঃখ বুঝতে চান না, তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন, তখন সত্যি মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়! যে দেশে শিক্ষকরা তাদের সন্তানসম শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন না, তাদের দুঃখকষ্ট বোঝার চেষ্টা করেন না-সে দেশের ভবিষ্যৎ কী?
তবে আশার কথা, আমাদের দেশে ইদানীং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটি অনেক ক্ষেত্রেই ‘বিবেকের’ ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসছে। তারা যখন যেখানে যাকে যতটুকু টাইট দেওয়া দরকার তাই দিচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাইরে তারাই একমাত্র মাইর বা পেটানোর মহৌষদটা চালু রেখেছে।
সর্বশেষ তারা পরীক্ষায় নকলের সুযোগ না দেওয়ায় পাবনার সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মো. মাসুদুর রহমানকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছেন। না, ভীরু কাপুরুষ কিংবা চোরের মতো নয়, তারা বীরের মতো প্রকাশ্যে কলেজের গেটেই ৩৬তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারের এ প্রভাষককে কিল, ঘুষি ও লাথি মেরে পরীক্ষায় নকলের সুযোগ না দেয়ার প্রতিবাদ করেছেন। সত্যিই তো, পরীক্ষা আবার কি? জীবনটাই যেখানে একটা পরীক্ষা, সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা পরীক্ষার বিধান রাখতে হবে কেন?
মানুষের ধৈর্য-সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে! আর পরীক্ষা যদি দিতেই হয়, তবে তা অবাধ ও মুক্ত হওয়া উচিত। একজন শিক্ষার্থী চাইলে অন্যের খাতা দেখে লিখবে, বই দেখে লিখবে যেভাবে খুশি সেভাবে লিখবে! আর লিখলেই কি, না লিখলেই বা কি? এটাই তো স্বাধীনতা, না কি? কিন্তু সেই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা কোনো আদর্শ শিক্ষকের কর্ম হতে পারে না।
পাবনার ওই শিক্ষকটি সম্ভবত বাংলার শিক্ষক হওয়ার কারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এসব প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেননি! বাস্তবজ্ঞানও তার পর্যাপ্ত নেই। কেন ভাই, আপনাকে কেন এত-এত দায়িত্ব নিতে হবে? কেউ যদি সামান্য একটু নকল করে, একে-অপরের খাতা দেখে লেখে-লেখুক না! এই দেশে সবই যেখানে নকল আর ভেজালে সয়লাব, তখন আপনার এমন ফেরাস্তাগিরির দরকারটা কী? আপনার বরং উচিত ছিল তাদের সহায়তা করা। নিজে এগিয়ে গিয়ে একটা প্রশ্নের উত্তর বলে দিতে পারতেন। প্রয়োজনে উত্তরপত্র সরবরাহ করতে পারতেন। তা না করে আপনি কেন টোকাটুকিতে বাধা দিতে গেলেন?
আর বাধাই যদি দেবেন, তবে সবকিছু বিবেচনা করে কেন দিলেন না? এদেশে এখন ক্ষমতাসীন দল মানেই ‘যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা।’ ওরা ইচ্ছে হলে কাউকে পেটাবে। ইচ্ছে হলে ধর্ষণের হুমকি দেবে। ইচ্ছে হলে সর্বস্ব কেড়ে নেবে। প্রয়োজন হলে কাউকে চিতা কিংবা কবরেও পাঠাতে পারে। কে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক, কাকে নকলে বাধা দিলে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে-এসব আগেভাগে বুঝতে পারাই হচ্ছে বিচক্ষণতা।
বিচক্ষণ ব্যক্তি পরিণাম বুঝে কাজ করেন। অপরিণামদর্শী কোনো ব্যক্তি শিক্ষক কেন, কোনো পেশার জন্যই মানানসই নয়। শচীন সেনগুপ্তের সিরাজউদ্দৌলা নাটকে মোহনলালকে উদ্দেশ করে নবাব সিরাজের বাণীটি এক্ষেত্রে মনে করা যেতে পারে: বন্দুকের গুলির সামনে বুক পেতে দাঁড়ানো বীরত্ব নয়! কাজেই পাবনার যে শিক্ষকটি চর-কিল-লাথি হজম করেছেন, সেটা তার প্রাপ্যই বলা যায়! যে ব্যক্তি নিজের ভালো নিজে বোঝে না, তাকে কে ভালো রাখবে?
শিক্ষককে কিল-চড়-লাথি মেরে ক্ষমতাসীন দলের যুবারা খারাপ কিছু করেছে বলে মনে হয় না। শিক্ষক পেটানো, সাংবাদিক পেটানো, প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ, সম্মেলন, মিছিল, বিক্ষোভ, ঘেরাওসহ যে কোনও ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি শক্তি দিয়ে দমন করা— ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন এগুলো করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। অপছন্দের ব্যক্তি কিংবা প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করার নীতি আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে।
‘মাইরের ওপর কোনও ওষুধ নাই’—এটা আমাদের দেশে স্বীকৃত একটা সামাজিক নীতি। শক্তিমানেরা দুর্বল-অশিষ্ট-অবাধ্যদের শায়েস্তা করতে, নিরীহদের বশে রাখতে যুগ যুগ ধরে ডাণ্ডার ওপরই ভরসা করেছে। আমাদের রাজনীতিতে সমালোচনা, প্রতিবাদ, আন্দোলন যে কোনও ধরনের বিরোধিতা দমন ও প্রতিপক্ষকে ঠাণ্ডা করতে মাইর বা শক্তি প্রয়োগের নীতি কার্যকর হয়ে আসছে। আইয়ুব, ইয়াহিয়া থেকে শুরু করে জিয়া-এরশাদ-খালেদা-হাসিনা পর্যন্ত সবাই কম-বেশি শক্তি বা ‘ডাণ্ডা’র ওপর নির্ভরশীল হয়েই ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করেছেন এবং করছেন। ডাণ্ডা যে কোনও শাসকের জন্যই প্রধানতম অবলম্বন। বল ও ভরসা।
চড়, থাপ্পর, লাথি, ডাণ্ডা, লাঠি, মাইর—মোটের ওপর শক্তি প্রয়োগের নীতি আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয়। সমাজে এসবের আলাদা গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে। শুধু ‘শক্তিমান’ সরকারের জন্যই এ দাওয়াই নয়, আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনেও এর উপযোগিতা ও কার্যকারিতা দেখা যায়। সমাজে অশিষ্ট, বেয়াদব, ঘাড়ত্যাড়া, উদ্ধতদের বাগে আনতে, ঘাড় সোজা করতে যুগে যুগে চড়-থাপ্পড় বা মাইর মহৌষধ হিসেবে কাজ করেছে। গ্রামেগঞ্জে একেবারে শিশু অবস্থা থেকেই মাইরের চর্চা শুরু হয়।
মাইরের ভয়েই শিশুরা বাবা-মায়ের অবাধ্য হয় না। সনাতন রীতির শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুলে শিক্ষকরা বেতিয়ে তথা মাইরের সাহায্যেই ‘গাধা’ ছাত্রকে ‘মানুষ’ করার দায়িত্ব পালন করতেন! কুকুর-বেড়াল থেকে শুরু করে যে কোনও অবাধ্যকেই চড়-থাপ্পর বা মাইরের সাহায্যে উচিত শিক্ষা দেওয়ার কাজটি করা হয়। কী পারিবারিক জীবনে, কী সামাজিক জীবনে যে কোনও অপরাধের শাস্তি দেওয়া হয় চড়, কিল বা লাঠিপেটার মাধ্যমে। মাইরের ওপরে সত্যিই কোনও ওষুধ নেই। মাইরের চোটে ঠাণ্ডা বা সোজা হয়নি, এমন উদাহরণ বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মাইর একাধারে অপরাধী, অশিষ্ট, পাগল, ভূত—সবাইকেই শান্ত বানিয়ে ফেলে। আমাদের সমাজে যতটুকু যা শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা তা সম্ভবত ওই ডাণ্ডা বা মাইরেরই অবদান! অপরাধীদের কথাই ধরা যাক। রিমান্ডে না নিলে অর্থাৎ না প্যাঁদালে কারও পেট থেকে কোনও তথ্য বের হয় না।
কোনও গুরুতর অভিযোগে কাউকে আটক করুন, এরপর বাবা-সোনা বলে, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করুন, ওই কর্মটি করেছে কিনা, নিশ্চিতভাবেই সে তা অস্বীকার করবে।
অথচ তাকে আচ্ছামতো ‘পেঁদিয়ে’ তারপর জেরা করুন, সে যা করেছে তা তো স্বীকার করবেই; এমনকি যা করেনি তাও সুবোধ বালকের মতো কবুল করবে। এই ‘ডাণ্ডা-অস্ত্র’ প্রয়োগ করে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কত না অসাধ্য সাধন করছে। আসলে মাইরের একটি আলাদা শক্তি আছে। এর মাধ্যমে অবশ্যম্ভাবী ঘটনাকে যেমন ভেস্তে দেওয়া যায়, ঠিক তেমনি অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়।
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বীর সেনানীরা যে কেবল পাবনার ওই শিক্ষককে পিটিয়েছে, তা কিন্তু নয়। নতুন কমিটি গঠনের পর পদবঞ্চিত বিক্ষুব্ধ কর্মীদেরও তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিনে পিটিয়েই ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করেছে। এ ক্ষেত্রে নিজ দলের কিংবা ছেলেতে মেয়েতে কোনো প্রভেদ করেনি। মেয়েরাও সমানভাবে মার খেয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের বীর সেনানীরা কত আধুনিক, কত সংবেদনশীল, কত সাম্যবাদী! তারা নিজ দলের বিক্ষুব্ধ কর্মীসমর্থকদের পর্যন্ত ক্ষমা করেনি!
আর যদি শুধু ছেলেদের গায়ে হাত তুলত, তাহলে অনেক সমালোচকই হয়তো বলতো, তারা ছেলে বলেই মার খেয়েছে, কই মেয়েদের তো কিছুই করল না! ছাত্রলীগ তো আর এতটা অসংবেদী হতে পারে না। তাই তারা মেয়েদেরও পিটিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, তাদের কাছে নারীপুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবার জন্য একই রকম পিটনি বরাদ্দ! মাইরের ক্ষেত্রে তারা কোনো জেন্ডার-গ্যাপ রাখেননি। লিঙ্গ-সমতার চরম দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছেন।
ছাত্রলীগের বীর সেনানীদের অভিনন্দন জানাই! আপনাদের নির্ভেজাল ‘মাইরতন্ত্র’ অব্যাহত থাকুক। গোটা দুনিয়া জানুক আপনাদের বীরত্বের কথা!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)