কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক ও নির্মাণের মহান কারিগর ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। টিভি নাটকে তার অবদান বাঙালি মাত্রই জানেন। চরিত্র ‘আবিষ্কার’-এর জন্যও হুমায়ূন ছিলেন ঈর্ষনীয় পর্যায়ের। তার হাত ধরে বেশকিছু গুণী অভিনেতা অভিনয়ে নাম লেখা, যারা কখনোই অভিনয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চ্যালেঞ্জার।
হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে ‘হাবলঙের বাজার’ নামের একটি নাটকের মধ্য দিয়ে অভিনয়ে আসেন চ্যালেঞ্জার। এই নামটিও হুমায়ূন আহমেদের দেয়া। তার মূল নাম এএসএম তোফাজ্জল হোসেন। অভিনয় জগতে খুব অল্প সময় বিরাজ করেছেন তুখোড় চ্যালেঞ্জার। এই অল্প সময়েই দর্শকের প্রিয় অভিনেতায় পরিনত হন তিনি। তাকে বলা হতো ছোটপর্দার ‘সুপারস্টার’!
চ্যালেঞ্জারকে দিয়ে অভিনয় করানোর বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদ তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘ফাউন্টেন পেন’-এ এভাবে লিখেন: তাকে (চ্যালেঞ্জার) আমি প্রথম যে নাটকে নিলাম তার নাম ‘হাবলঙের বাজার’। নাটকের কাহিনী হচ্ছে গরমের সময় ডাক্তার এজাজের মাথা এলোমেলো হয়। তার বিয়ের দিন মাথা খুব এলোমেলো হলো। ঠিক করা হলো, মাথা কামিয়ে সেখানে এলাজ দেওয়া হবে। শর্ট নেওয়ার আগে আগে দেখা গেল নাপিত আনা হয়নি। কীভাবে নাটক বানানো হয় তা দেখার জন্য চ্যালেঞ্জার তার স্ত্রীকে নিয়ে গেছে শুটিংস্পটে। দুজনই আগ্রহ নিয়ে নাটক বানানো দেখছেন। আমি চ্যালেঞ্জারের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমি তো সব কিছুকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নাও। এসো নাপিতের ভূমিকায় অভিনয় করো।’ চ্যালেঞ্জার বলল, ‘স্যার আপনি যা বলবেন তা-ই করব। মাটি খেতে বললে মাটি খাব। নাটক পারব না।’ আমি বললাম, ‘তুমি পারবে। নাও ক্ষুর হাতে নাও।’ চ্যালেঞ্জার ছোট্ট একটা ভূমিকায় অভিনয় করল। আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম, তার ভেতর সহজাত অভিনয়ের আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। তাকে এক ঘণ্টার একটি নাটকে প্রধান চরিত্র করতে বললাম, নাটকের নাম ‘খোয়াবনগর’। সেখানে আমার মেজো মেয়ে শীলা অভিনয় করেছিল। নাটকের শেষে আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা! চ্যালেঞ্জার নামের এই নতুন অভিনেতার অভিনয় তোমার কেমন লাগল?’ শীলা বলল, ‘আসাদুজ্জামান নূর চাচাকে আমার এ দেশের সবচেয়ে বড় অভিনেতা বলে মনে হয়। আমি আজ যাঁর সঙ্গে অভিনয় করলাম, তিনি নূর চাচার চেয়ে কোনো অংশে কম না।’ আমি বললাম -‘বাবা! তোমার কী মনে হয় সুপারস্টার হিসেবে তার পরিচয় হবে?’ শীলা বলল, ‘অবশ্যই’। আমার ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’তে পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করে সে নিজেকে সুপারস্টার প্রমাণিত করলো।
চ্যালেঞ্জার নেই নয় বছর। যার হাত ধরে অভিনয়ে এসেছিলেন, তার আগেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর মস্তিষ্কের ক্যানসারে মারা যান তিনি। মৃত্যুর পর আজও সমান জনপ্রিয় এই অভিনেতা। এখনো ইউটিউবে তার অভিনীত নাটক মানুষকে পুলকিত করে, আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে। তার মৃত্যু দিনে তাকে স্মরণ করছেন তার ভক্ত অনুরাগীরা।
বড় ভাই চ্যালেঞ্জারের মৃত্যুদিনে স্মরণ করছেন ছোট বোন ও অভিনেত্রী মনিরা মিঠু। ফেসবুকে চ্যালেঞ্জারের কিছু ছবি পোস্ট করে এই অভিনেত্রী লেখেন: ‘আজ আমার ভাইয়ের মৃত্যু বার্ষিকী,আল্লাহ আমার ভাই এবং তার পরিবারকে শান্তিতে রাখুক। পৃথিবীর সব বোনেরা থাকুক ভাইয়ের আদরে!’
টিভি ও চলচ্চিত্র মিলিয়ে চ্যালেঞ্জারের কাজের সংখ্যা দুই শতাধিক। তাঁর অভিনীত বৃক্ষ মানব, শওকত সাহেবের গাড়ি কেনা, যমুনার জল দেখতে কাল, চন্দ্র কারিগর, লীলাবতী, জুতা বাবা, খোয়াব নগর, চোর, পিচাশ মকবুল উল্লেখযোগ্য। সিনেমাগুলোর মধ্যে শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘লাল সবুজ’, হুমায়ূন আহমেদের শ্যামল ছায়া, নয় নম্বর বিপদ সংকেত ও দারুচিনি দ্বীপ এবং আমজাদ হোসেনের ‘কাল সকালে’ উল্লেখযোগ্য।