১ অক্টোবর চ্যানেল আইয়ের জন্মদিন। ১৯৯৯ সালে চ্যানেল আই যখন যাত্রা শুরু করে, অন্য অনেকের মতো আমিও টেলিভিশন সেটের সামনে বসে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখেছি। চ্যানেলটির অন্যতম কর্ণধার ফরিদুর রেজা সাগর ভাই আগে থেকেই কিছুটা চিনতেন শিশুসাহিত্য করার কারণে। তাছাড়া ৯৪ সালের দিকে সাগর ভাই যখন বিটিভিতে আলী ইমাম ভাইয়ের ‘প্রত্যাশার আলো’ নামে একটা অনুষ্ঠান করতেন তখন আমার প্রথম বই ‘মেডিকেল প্রেসক্রিপশন’ প্রকাশিত হয় অনুপম প্রকাশনী থেকে।
বইটি প্রকাশের কিছুদিন পর ‘ঢাকা বইমেলা’ শুরু হয় সম্ভবত বিজয় সরণীতে মিলিটারি যাদুঘরের জায়গাটিতে। পত্রিকায় রিভিউ দেওয়ার জন্য নতুন বইয়ের ২টা কপি নিয়ে মেলা থেকে বেরিয়েছি, সাথে ছড়াকার ওবায়দুল গণি চন্দন। একই সময়ে মেলা থেকে বেরুনোর পথ করে বের হচ্ছিলেন সাগর ভাই।
চন্দন সাগর ভাইকে দেখে হাত তুলতেই সাগর ভাই গাড়ি থামিয়ে নেমে এলেন, হাত মেলালেন, কুশল বিনিময় করলেন। এর মধ্যে চন্দন, সাগর ভাইয়ের সাথে আমাকে আবার বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বললো- উনি ডা. সজল আশফাক ছড়াকার, জনকণ্ঠের স্বাস্থ্যপাতা দেখেন, ওনার একটা বই বেরিয়েছে। সাগর ভাই চন্দনের কথার জবাব না দিয়ে শুধু বললেন, ওকে আমি চিনি। কই দেখি বইটা- বলেই আমার দিকে বইয়ের জন্য হাত বাড়িয়ে বইটা নিলেন সাগর ভাই। আমি বললাম- বি চৌধুরী স্যার ভূমিকা লিখেছেন।
উনি খুব দ্রুত বইটি একটু দেখে বইটি হাতে নিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে বললেন, আগামীকাল রাত ১০টায় প্রত্যাশার আলো দেখো। এভাবে পথের মধ্যে বইটি সাগর ভাইকে দেয়াটা আমার কাছে ঠিক শোভন এবং কার্যকরী কিছু হলো বলে মনে না হওয়ায় কিছুটা বিব্রত বিবেক থেকে আমি বলে উঠি- আমি একটা রিভিউ লিখে দিলে মনে হয় ভালো হতো। আমার কথা শুনে সাগর ভাই ডানহাতের আঙ্গুল গুলো ঈষৎ প্রসারিত করে ইতিবাচক সাড়া দিলেন।
পরদিন ‘প্রত্যাশার আলো’তে যেভাবে বইটিকে উপস্থাপন করা হলো তা ছিল আমার প্রত্যাশার বাইরে। সাগর ভাই বইটি হাতে নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অন্তত কয়েক মিনিট নানা কথা বলে গেলেন বইটি নিয়ে। তখন বিটিভি ছাড়া কোন টিভি চ্যানেল ছিল না। কাজেই বেশ সাড়া পড়ে গেল পাঠকদের মধ্যে।
তারপর সাগর ভাইয়ের সাথে আর ২/১ বার ছাড়া বিশেষ দেখা হয়নি। ইতোমধ্যে আমি বিটিভিতে ‘জীবনের জন্য’ নামে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাত্র ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে শিখছি।
২০০৪ সালের দিকের কথা, ছড়াকার আমীরুল ইসলাম ততোদিনে চ্যানেল আইয়ের সাথে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। হঠাৎই একদিন আমীরুল ভাইয়ের ফোন পেলাম। ফোনে উনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় বললেন- কী করো মিয়া। তোমারে তো সাগর ভাই খুঁজতাছে। আমরা স্বাস্থ্যের উপর একটা লাইভ অনুষ্ঠান করবো, তুমি উপস্থাপক, পারবা না? নাকি ভয় পাইতাছো? ২/১ দিনের মধ্যেই আসো চ্যানেল আইতে, সাগর ভাইয়ের সাথে দেখা কইরা যাও। তারপর ২০০৪ সালের আগস্টে ‘টেলিপ্রেসক্রিপশন’ দিয়ে শুরু হলো চ্যানেল আইয়ের সাথে আমার পথচলা।
শুরুর দিকে চ্যানেল আইয়ের আরেক ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ মানে সিরাজ ভাই একদিন গেট আপ নিয়ে কিছু উপদেশ দিলেন। প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন খুব পজেটিভ। সিরাজ ভাইয়ের একটি কথা খুব মনে পড়ে। প্রথম অনুষ্ঠান অনএয়ারে যাওয়ার পর উনি আস্তে করে বললেন- খুব ভালো, যেটুকু সমস্যা আছে ঠিক হয়ে যাব, ডাক্তারদেরকে স্ক্রিনে টাই পরে থাকলে ভালো লাগে। আর আমীরুল ভাই বললেন, সিঙ্গেল কালার ব্রাইট ফুল স্লিভ শার্ট। তারপর সেই গেটআপ নিয়েই ২০১৬ এপ্রিল পযর্ন্ত অনুষ্ঠান করেছি। প্রায় একযুগ। চ্যানেল আই-এর সাথে আমার এই যুগ আমার জীবনের অন্যতম অর্জন এবং অভিজ্ঞতা।
চ্যানেল আই-এর প্রত্যেকেই এতো আন্তরিক, নিজেকে সবসময়ই সেই পরিবারের সদস্য মনে হয়েছে। অন্য চ্যানেলে অনুষ্ঠান করার অফারও বিনীতভাবে ফিরিয়ে দিয়েছি। কারণ আমি জানতাম, চ্যানেল আই-এর সাথে গড়ে ওঠা আন্তরিক বন্ধন আমি ছিন্ন করতে পারবো না। যখনই চ্যানেল আইয়ে গিয়েছি– মনে হয়েছে, এটি একটি পরিবার। পরস্পরের প্রতি পরস্পর অনেক বেশি আন্তরিক -শ্রদ্ধাশীল। আমার মনে হয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে এটাই চ্যানেল আইয়ের বড় শক্তি। চ্যানেল আইয়ের উনিশে পদার্পণে চ্যানেল আইকে খুব মনে পড়ছে। মনে পড়ছে প্রতি রবিবার সাড়ে দশটা বাজলেই জামাল রেজার ফোন, ভাই কতদূর। খুব মিস করি কন্ট্রোল রুম থেকে টকব্যাকের কথাগুলো। সজল ভাই রেডি…টাইটেল যাচ্ছে…থ্রি..টু..ওয়ান..গো…।
প্রায়শই টেলিফোনে ভেসে আসা সেই কথোপকথনগুলোর কথা মনে পড়ছে- সজল, আমি আমীরুল (আমীরুল ইসলাম, অনুষ্ঠান নির্বাহী), বন্যা আপার (রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী) সাথে একটু কথা বলো, ওনার গলার স্বরে কি যেন সমস্যা হয়েছে…….। আর শোন সাগর ভাইয়ের সাথে কথা বলো, খালাম্মার (কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন) কানে সমস্যা, চলো দেখে আসি। খুব মিস করি- সজল ভাই, আমি হেলাল (সার্বিক ব্যবস্থাপক), আমাদের একটা ছেলে আপনাদের হাসপাতালে ভর্তি, একটু খোঁজ নিয়েন।
চ্যানেল আই’র অ্যাকাউন্টস সেকশনের জিয়া ভাই ফোন করে বলতেন- ভাই চেক রেডি, কাউকে পাঠিয়ে দেন। কখনোই ভোলা যাবে না, চ্যানেল আই এর তৎকালীন জিএম মাসুদ ভাইয়ের চূড়ান্ত বিনীতভাবে আমার সাথে কথা বলার জন্য ১ মিনিট সময় চাওয়ার কথা। যাদের ভালোবাসার কাছে আমি ঋণী তাদের সেই তালিকা অনেক দীর্ঘ। ক্ষুদ্র এই জীবনে দীর্ঘ ভালোবাসা প্রাপ্তির জন্য আমি কৃতজ্ঞ চ্যানেল আইয়ের কাছে, সবকিছুর জন্য ততোধিক কৃতজ্ঞ সৃষ্টিকর্তার কাছে।