প্রবল পরাক্রমদের, একনায়কতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর এই ছবি, এমন শক্তিশালী ছবি খুব কমই আছে বিশ্ব ইতিহাসে। তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে চীনের গণতন্ত্রপন্থীদের ঐতিহাসিক বিক্ষোভের সময়ের এই ক্ষণ।
১৫ জুলাই থেকে ৪ জুন, ১৯৮৯ এর সেই বিক্ষোভ যখন সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নে স্তিমিত, সামরিক আইন জারি, সেনাদের অগ্রাভিযানে উত্তাল জনস্রোত আর নেই, তখনই এই অনবদ্য আলোকচিত্রের সৃষ্টি। শূন্য তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কের সারির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার ওই ছবিটি ৫ জুনের। সেই ক্ষোভ-ঝঞ্চাই একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে গড়ে তুলেছে একজন তুমুল দ্রোহী হিসেবে।
চীনের চোখে এই সাবেক অধ্যাপক লিও জিয়াওবো অপরাধী, কিন্তু নিজের প্রতি তার মূল্যায়ন “আমি অপরাধমূলক কোন কাজ করিনি। কিন্তু আমার কোন অভিযোগও নাই।”
লিউ জিয়াওবো ২০০৯ সালে কোর্টে দাড়িয়ে এমনটি বলেন। এর আগে থেকেই অবশ্য তিনি আট বছরের সাজা খেটে আসছিলেন। পরে আবার মৃত্যুর আগপর্যন্ত ১১ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করে আসছিলেন, যা আরোপিত হয় ২০০৯ সালে। এসময় অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদেরও দণ্ড দেওয়া হয়, চার্টার ০৮ ম্যানিফেস্টোর জন্য।গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতি থেকে অনেকে সরে আসলেও আজীবন অটল, দৃড় ছিলেন লিও।
১৯৮৯ সালে ‘জুন ফোর্থ ইনসিডেন্ট’ নামের সেই বিক্ষোভ চীন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৯ সালের চীনের একদলীয় কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়ার হয়ে উঠে আন্দোলনের মূল কেন্দ্র। ‘৮৯ গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন’ নামেও পরিচিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবিতে এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলো চীনের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা। সরকারের কঠোর অবস্থানের প্রেক্ষিতে জুনের ৩-৪ তারিখে তা চরম পরিণতি পায়।
শহরজুড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়, কিন্তু উত্তাল জনসমুদ্রের কারণে তারা তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে পৌঁছাতে পারছিলো না। গণতন্ত্রের দেবীর একটি প্লাস্টার ভাস্কর্য্যকে ঘিরে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হয়।
তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে অগ্রসরমান সেনাবাহিনীকে রুখতে কয়েকশত বিক্ষোভকারী নিহত হয় বলে ধারণা, এজন্য একে তিয়েনআনমেন স্কোয়ার হত্যাকাণ্ড নামেও অভিহিত করা হয়। সরকারি হিসেবে মারা যায় সেনাসহ ২৪১ জন, আহত হয় ৭০০০। তবে অনেকের মতেই তা আরও অনেক বেশি। অনেকের মতেই নিহতের সংখ্যা হাজার ছাড়ায়। হাজার হাজার বিক্ষোভকারী আটক হয়, তাদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এই ঘটনার ব্যাপক প্রচারের ফলে আমেরিকার কূটনৈতিক ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে চীন। অন্যান্য দেশও এর তীব্র সমালোচনা করে।
লিও জিয়াওবো
১৯৫৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিলিনের চ্যাংচুনে লিও জিয়াওবোর জন্ম। একজন অ্যাকাডেমিশিয়ান হিসেবে কর্মজীবন শুরু তার। সাহিত্য ও দর্শনে পড়াশোনা করা লিও বেইজিং এর একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক হিসেবে তার শান্ত-নিস্তরঙ্গ জীবন উত্তাল করে তোলে ১৯৮৯ সালের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের আন্দোলন। অনেকেই গণতন্ত্রের এই আন্দোলনে পিছু হটলেও তিনি অটল থাকেন।
তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের সেই বিক্ষোভের সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং স্কলার ছিলেন। ফিরে আসেন এপ্রিলে। সেই বিক্ষোভে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন তিনি। শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভকারীদের বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে সেনাবাহিনীর সাথে সফল মধ্যস্থতায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। এতে করে শত শত জীবন বেঁচে যায়।
আটকদের মুক্তির দাবিতে প্রচারণা অভিযানের জন্য কারাদণ্ড দেয়া হয় লিউকে। চীনের উত্তর-পূর্বাংশের শ্রম শিবিরে তাকে ৩ বছরের জন্য আটক রাখা হয়। কিন্তু এর মধ্যেই তিনি ১৯৯৬ সালে কবি লিউ জিয়াকে বিয়ে করেন। পরে অবশ্য তিনি মুক্তি পান এবং গণতন্ত্রের পক্ষে তার অভিযান অব্যাহত রাখেন।
একদলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে বহু দলীয় গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য আজীবন লড়ে গেছেন লিউ। ভিন্ন মত অবলম্বন করায় এবং সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে তাকে বার বার কারাবরণ করতে হয়েছে। এমনকি তাকে গৃহবন্দীও করা হয়েছে। তার স্ত্রীকেও গৃহবন্দি করা হয়।
নোবেল বিজয়ী চীনের প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী লিও জিয়াওবো আজ ৬১ বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে লিভার ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
জীবনের শেষ কিছু দিন তিনি শুধু কয়েকদিন হাসপাতালে তার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে পেরেছেন। বিদেশে তার চিকিৎসার আবেদনও নাকচ করে দেয় চীনা কর্তৃপক্ষ।
অনেকের চোখেই লিও হিরো, কিন্তু নিজের দেশের সরকারের কাছে সে ভিলেন। “চীনে মৌলিক মানবাধিকারের জন্য দীর্ঘ ও অহিংস আন্দোলনের” জন্য এই রাজনৈতিক কর্মী ২০১০ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। চীনের মানুষের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য ‘শীর্ষস্থানীয় প্রতীকী’ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে। কিন্তু নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে সুইডেন যেতে পারেননি তিনি। কারারুদ্ধ অবস্থাতেই বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে নোবেল পুরস্কারে ভুষিত হন তিনি।
নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, তার অকাল মৃ্ত্যুর জন্য চীনা সরকার অনেকাংশে দায়ী।