উইঘুরসহ স্থানীয় মুসলিম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে ‘পুনর্শিক্ষা’র নামে বন্দী শিবিরে রাখা সংক্রান্ত চীন সরকারের একটি গোপন নথি হাতে পাওয়ার দাবি জানিয়েছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি।
সে নথি অনুসারে দাঁড়ি রাখা, কোনো এক সময় নিয়মিত মাথায় ঘোমটা দেয়া বা মুখ ঢেকে রাখা, এমনকি ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে গিয়ে ভুলবশত বিদেশি ওয়েবসাইটে ঢুকে পড়াকেও কারণ দেখিয়ে আটকে রাখা হয়েছে অসংখ্য মানুষকে।
বিবিসি’র বিশ্লেষণ অনুসারে, চীন তার মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্য কীভাবে নির্ধারণ করছে তা বুঝতে এটি এ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে শক্তিশালী ও তথ্যবহুল একটি দলিল।
নতুন তালিকাটিতে থাকা ব্যক্তিদের পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে অনেক তথ্য ঢেকে তারপর গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে কিছু তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিসি। যেমন, ৫৯৮ নম্বর সারিতে হেলচেম নামের ৩৮ বছর বয়সী এক নারীর কথা বলা হয়েছে যাকে ‘শিক্ষা শিবিরে’ পাঠানো হয়েছে মূলত একটি কারণে: কয়েক বছর আগে তিনি টানা ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতেন বা বোরকা পরতেন।
৬৬ নম্বর সারিতে উল্লেখ করা মেমেত্তোহতি নামের ৩৪ বছর বয়সী আরেক ব্যক্তি শুধু পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছিলেন বলে তাকে আটক করা হয়েছে। যদিও তার নামের পাশে লেখা হয়েছে: ‘কোনো বাস্তবিক ঝুঁকি নেই’।
আবার ২৩৯ নম্বর সারিতে রয়েছে নুরমেমেত নামের ২৮ বছর বয়সী এক তরুণের তথ্য, যিনি ‘মোবাইল ফোনে একটি ওয়েব-লিংকে ক্লিক করার মাধ্যমে অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি বিদেশি ওয়েবসাইটে ঢুকে যাওয়া’র কারণে শিক্ষা শিবিরে স্থান পেয়েছেন।
ওপরের তিনজনের মতো একই ধরনের কারণে শিবিরে আটকা পড়ে আছেন উইঘুর, কাজাখ এবং কিরগিজসহ চীনের বহু সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষ।
গত বছরও চীনের মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ জিনজিয়াংয়ের একটি সূত্র থেকে এমনই কিছু স্পর্শকাতর সরকারি নথিপত্র ফাঁস হয়েছিল। ওই একই সূত্র ব্যক্তিগত ঝুঁকি থাকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে এবারের নথিগুলো ফাঁস করেছে বলে দাবি করেছে বিবিসি।
জিনজিয়াংয়ে চীন সরকারের নীতি বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ড. এড্রিয়ান জেনজের বিশ্বাস নতুন নথিগুলো আসল। তিনি ওয়াশিংটনের ‘ভিকটিমস অব কমিউনিজম মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন’র একজন সিনিয়র ফেলো।
‘বেইজিং যে বিশেষ একটি ধর্মের মানুষের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডগুলোকেও সক্রিয়ভাবে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দিচ্ছে, সে বিষয়ে এই অসামান্য নথিটি আমার দেখা এ যাবতকালের সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ,’ বলেন তিনি।
এর মধ্যে ‘চার নম্বর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে একটি শিবিরকে চিহ্নিত করেছেন ড. জেনজ, যেখানে গত বছর চীনা সরকারের আয়োজিত সফরের অংশ হিসেবে গিয়েছিল বিবিসি’র একটি দল।
ওই সময় বিবিসি’র দলটি যেসব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছিল তার সঙ্গে নতুন এই নথির তথ্যের অনেক মিল রয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদ মাধ্যমটি।
কলাম এবং সারিতে ভাগ করা ১৩৭ পৃষ্ঠার নতুন এ নথিতে ৩ হাজারেরও বেশি মানুষের নাম-পরিচয়সহ তাদের দৈনন্দিন জীবনের অসংখ্য বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। দিনে কতবার তারা প্রার্থনা করেন, কেমন পোশাক পরেন, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদের আচরণ কেমন – সব।
এর মধ্যে প্রধানত ৩১১ জন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাদের বিষয়ে তদন্তের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে এ তালিকায়। তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইতিহাস, ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং কাছে-দূরের কয়েকশ’ আত্মীয়, প্রতিবেশী এবং বন্ধুর সঙ্গে তাদের সম্পর্কের খুঁটিনাটির উল্লেখ রয়েছে এখানে।
প্রত্যেকের তথ্যের পাশে শেষ কলামে লেখা হয়েছে সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ এদের যারা ইতোমধ্যে বন্দী শিবিরে রয়েছেন তারা বন্দীই থাকবেন নাকি ছেড়ে দেয়া উচিত এবং যাদেরকে আগে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল তাদের কাউকে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন রয়েছে কিনা।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন সবসময়ই বলে এসেছে: উইঘুর জনগোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিত সংঘবদ্ধ নির্যাতন হচ্ছে। কিন্তু চীন তা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। তাদের দাবি, জিনজিয়াংয়ে যেগুলোকে বন্দী শিবির বলা হচ্ছে সেগুলো আসলে স্কুল। এসব স্কুলে তাদেরকে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।
নতুন এই প্রমাণ উইঘুর জনগোষ্ঠীকে নিয়ে চীন সরকারের দাবির একেবারেই বিপরীত।
নতুন তালিকার ৩১১ মূল ব্যক্তির সবাই দক্ষিণ জিনজিয়াংয়ের হোতান শহরের কাছে অবস্থিত কারাকাক্স কাউন্টির অধিবাসী। তাই এর নাম দেয়া হয়েছে ‘কারাকাক্স লিস্ট’।