সারাবিশ্বে মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা পৌনে চারলক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে,গত বছরের ডিসেম্বরে এই রোগের প্রাদুর্ভাব হয় চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে। রোগ শনাক্তের পর থেকে প্রথম এক লাখে পৌঁছাতে দুইমাসের বেশি সময় নিলেও ক্রমে সেই গতি বাড়তে থাকে।৬৭ দিনের মাথায় রোগী সংখ্যা এক লাখে গেলেও দুই লাখ রোগীতে পৌঁছাতে সময় নেয় পরের ১১ দিন, আর তিন লাখে সেটা পৌঁছায় পরের ৪ দিনে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এও বলছে এই রোগ থেকে বাঁচতে আক্রমণাত্মক পন্থা অবলম্বন করতে হবে। এই আক্রমণাত্মক পন্থার উপায় হিসেবে সংস্থাটি বলছে সামাজিক সুরক্ষার কথা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ড. টেড্রস অ্যাডহানম গেব্রেইয়েসুস এই রোগ থেকে বাঁচতে সকলকে ঘরে থাকতে বলছেন। একই সঙ্গে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশও করেছেন। নিরাপদে থাকলেই স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের কাজটা ভালোভাবে করতে পারবেন জানিয়ে তিনি স্বাস্থ্য সেবাকর্মীদের পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্টের (পিপিই) ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
চীন থেকে এই রোগের শুরু হলেও বর্তমানে শোচনীয় অবস্থায় আছে ইতালি, স্পেনসহ ইউরোপের দেশগুলো। এই দেশগুলোর সাধারণ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা। ইতালিয়ান ফেডারেশন অব ডক্টরস সোমবার জানিয়েছে, কভিড-১৯ করোনাভাইরাসে তাদের দেশে সংক্রমিত হয়েছেন ৪,৮২৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী, এবং এদের মধ্যে ২৩ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। ফ্রান্সে স্বাস্থ্যকর্মীদের ৪৯৯ জন সংক্রমিত হয়েছেন, এবং তাদের মধ্যে ৩ জন মারাও গেছেন। চীনের চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমিত হওয়ার পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন চিকিৎসকের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। এমন অবস্থায় চিকিৎসকেরা যে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে সেটা বলাই বাহুল্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও চিকিৎসা সেবাকর্মীদের এই ঝুঁকি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, এবং তারাও বলছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিপিই না থাকার কারণে এমনটা হচ্ছে।
গত ডিসেম্বর থেকে এই রোগের আলোচনায় এলেও বাংলাদেশে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় মার্চের ৮ তারিখে। এরপর সোমবার পর্যন্ত বাংলাদেশে শনাক্ত হওয়া এই রোগীর সংখ্যা ৩৩ জন। এদের মধ্যে পাঁচজন সুস্থ হয়েছে, এবং দুইজন মারা গেছেন; বাকিরা আছেন চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণে। শঙ্কার বিষয় এই ৩৩ রোগীর মধ্যে আছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরাও। সোমবার রাজধানীর মহাখালীতে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ব্রিফিংয়ে পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা জানিয়েছেন, আক্রান্তদের মধ্যে একজন চিকিৎসক এবং দুইজন স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। অর্থাৎ মাত্র ৩৩ রোগীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৩ জন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মী শনাক্ত হয়েছেন। এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলে এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় কে জানে!
দেশে চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন শুরু থেকেই বাংলাদেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু এই দাবিকে সরকার খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। চিকিৎসক ও সেবাকর্মীদের এই দাবিকে অগ্রাহ্য করে ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল কর্মীদের নিজ দায়িত্বে সুরক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা করার জন্যে নোটিস পর্যন্ত দিতেও আমরা দেখেছি। এনিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা হলেও সরকার এটাকে গুরুত্ব দেয়নি। উপরন্তু সোমবার (২৩ মার্চ) স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিতদের জন্যে পিপিইর প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব না দিয়ে সরাসরি বলেও ফেলেছেন- ‘চীনে যখন করোনাভাইরাস ধরা পড়েছিল, তখন তাদের কাছেও পিপিই ছিল না। এখনো আমাদের পিপিই অতটা দরকার নেই।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী চিকিৎসকদের সুরক্ষা পোশাক সম্পর্কে গুরুত্ব না দিলেও এর আগের দিনই করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তায় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) সংগ্রহ ও সরবরাহের জন্যে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট একই সঙ্গে চিকিৎসক, নার্সসহ হেলথ প্রোভিডরদের ঝুঁকি ভাতা চালু করার নির্দেশনা দেন। এরআগে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় নিয়োজিতদের সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহ করতে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের একাধিক আইনি নোটিস দিয়েছেন একাধিক আইনজীবী। কিন্তু এতকিছুর পরেও অদ্যাবধি সে ব্যবস্থা হয়নি।
চিকিৎসকদের দেওয়ার জন্যে পিপিই কি সরকারের হাতে নেই? আছে- এমনই বলছেন দায়িত্বশীলরা। আইইডিসিআর মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের মন্তব্য উদ্ধৃত করে একটি গণমাধ্যম জানিয়েছে, ডাক্তারদের জন্য ১০ লাখ পিপিই সংগ্রহ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও তার নানা বক্তৃতায় বলেছেন, পিপিই আছে, এছাড়া প্রয়োজনে আরও আমদানি করা হবে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী। এছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এক লাখ পিপিই দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যম।
এতকিছুর পরেও দেশের সকল পর্যায়ের চিকিৎসকদের কাছে এই পিপিই পৌঁছায়নি। তবে এই সময়ে পুলিশ-জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের কাছে এটা পৌঁছেছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও স্থিরচিত্রে দেখা যায়। হ্যাঁ, প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের কাছেও এই পিপিইও পৌঁছানোর দরকার, কিন্তু সরকারের যদি সীমিত সাধ্য থাকে তবে এখানে অগ্রাধিকার নিরূপণ করা উচিত। যে চিকিৎসক একজন রোগীর প্রথম কন্টাক্ট পারসন তার কাছেই প্রথমে যাওয়া উচিত ছিল।
এখানে দেশে কভিড-১৯ করোনাভাইরাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দিয়ে অগ্রাধিকার নিরূপণ করা উচিত নয়। কারণ এখন পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাস্থ আইইডিসিআর ছাড়া করোনা শনাক্তের আর কোন প্রতিষ্ঠান নাই। কিন্তু এই রোগের সন্দেহভাজন রোগী রয়েছেন সারাদেশে। জ্বর, সর্দি, কাশির মত সাধারণ লক্ষণ যেখানে করোনার সেখানে এই লক্ষণগুলো নিয়ে সন্দেহভাজন রোগী প্রথমেই যাচ্ছেন চিকিৎসকদের কাছে। এটা সংক্রামক বলে প্রথম স্পর্শেও এই রোগের বিস্তার ঘটতে পারে। এখানে তাই সংখ্যার হিসাব মুখ্য নয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রোগী কার কাছে যাচ্ছে প্রথমে। সন্দেহভাজন রোগীর মাধ্যমে কোন চিকিৎসকের দেহে এই রোগের সংক্রমণ হলে ওই চিকিৎসক দ্বারা আরও অধিক লোকের মধ্যে এই রোগের বিস্তারের শঙ্কা তাই থেকে যাচ্ছে।
সরকারের এখানে রোগ সংক্রমণের প্রান্তিক একটা স্তরের দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারত। বৈশ্বিক দুর্যোগের এই সময়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এটাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করার দরকার ছিল। এজন্যে কেবল সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকই শুধু নয় বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলে নিবন্ধিত সকল চিকিৎসকদের পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) সরবরাহ করে তাদেরকে ঝুঁকির বাইরে রেখে আরও সম্ভাব্য অনেক রোগীকে সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত ছিল। একই সঙ্গে এই দুর্যোগকালে বিএমডিসিতে নিবন্ধিত নন এমন কথিত চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করতে প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগেরও দরকার ছিল। এখন পর্যন্ত সরকার সেটা করেনি। তবে সরকার প্রথমে দৃষ্টি দিয়েছে প্রশাসনসহ শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিকে। তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে এগুলো দিতে আপত্তি নাই, কারও আপত্তি থাকার কথাও নয়; কিন্তু সকল পর্যায়ের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত কর্মীরা বাদ যাবেন কেন?
করোনা বৈশ্বিক মহামারি। এই মহামারি রুখতে সচেতনতা আর সুরক্ষার বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। সচেতনতার যে বিষয়টি দেশের ১৭ কোটি মানুষের, সুরক্ষা সেখানে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সঙ্গেও সম্পর্কিত। সরকার করোনা প্রতিরোধে উপযুক্ত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও পেশাজীবীদের সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে। এখন পর্যন্ত দেশের চিকিৎসকেরাসহ নানা পর্যায়ের সকল স্বাস্থ্য সেবাকর্মীগণ সরকারি এই সহায়তা পাননি, তবে এই সহায়তা দ্রুততার সঙ্গে তাদের দেওয়া উচিত।
আমাদের মনে রাখা দরকার, করোনা প্রতিরোধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন চিকিৎসা সেবায় জড়িত লোকজনেরাই। নিজেদের জীবনকে ঝুঁকিতে রেখে মানববাদকে যারা ব্রত হিসেবে নিয়েছেন তাদেরকে সহায়তা করা সরকারের পবিত্র দায়িত্ব। এই দায়িত্বকে অস্বীকার করার উপায় নাই, এই দায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই। এই দায়িত্বকে গুরুত্ব না দিলে বৈশ্বিক এই মহামারি সম্পর্কে অজ্ঞতারই প্রকাশ ঘটবে। বিশ্বাস করি, সরকার নামক প্রতিষ্ঠান অজ্ঞতাকে প্রশ্রয় দেয় না, অগ্রাধিকার নির্ধারণ-ভ্রান্তিতে হয়ত ভুগে, তবে একটা সময়ে ঠিকই সঠিক সিদ্ধান্তের কক্ষপথে ফেরে। আমরা সঠিক সিদ্ধান্তের প্রকাশ দেখতে চাই চিকিৎসা সেবায় জড়িতদের পিপিই সরবরাহসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)