চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

চাল নিয়ে চালবাজি করা ক্ষমতাধররা কারা?

পুরো দেশজুড়েই চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে নানা কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। গত তিন মাসের ব্যবধানে কেজি প্রতি প্রায় ৩০ টাকা চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সামনে আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেকে এই পরিস্থিতিকে ‘চালবাজি’ বলেও আখ্যায়িত করছেন। খোদ খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামও বলেছেন, ‘দেশে চাল নিয়ে চালবাজি হচ্ছে!’ তাই প্রশ্ন উঠেছে, কারা করছে এই চালবাজি? তারা কি সরকারের থেকেও বেশি ক্ষমতাধর? উত্তর যাইহোক, উত্তরের সঙ্গে সঙ্গে এসব বিষয় দেখতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাজটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

চালের দাম হু হু করে বাড়ায় দেশজুড়ে এ নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা তুঙ্গে। এই অবস্থায়  ১৪ সেপ্টেম্বর খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সচিবালয়ে তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বন্যা ও রোগবালাইয়ের কারণে ফসলহানির পরেও এক কোটি ৯২ লাখ টন ধান ঘরে উঠেছিল। দেশের ভেতর এত চাল থাকলেও এনিয়ে চালবাজি ও রাজনীতি হচ্ছে। চাল নিয়ে সমস্ত দেশকে একটা বিভ্রাটের মধ্যে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে চাল নিয়ে চালবাজি হচ্ছে, চাল নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে।’ একই সাথে তিনি দাবি করেছেন, ‘এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা চাল নিয়ে এই চালবাজি করছেন। আমরা চালবাজি ও ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছি।’

খাদ্যমন্ত্রীর কথা ধরে যদি আমরা এগিয়ে যাই, তাহলে এটুকু স্পষ্ট, সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোর জন্যই চাল নিয়ে সারা দেশেই এই অস্থির অবস্থা সৃষ্টি করা হচ্ছে। তবে এই পরিস্থিতি তো হুট করেই নয়, গত তিন মাস ধরেই। হিসেব মতে প্রতিমাসেই কেজি প্রতি চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ টাকা করে! বর্তমানে মোটা চাল কিনতে গেলেও ৫৮-৬০ টাকা করে দরকার হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ আগেও এই চাল বিক্রি হয়েছে ৪৮ টাকা থেকে ৫০ টাকা করে। বাজার সংশ্লিষ্টদের দাবি, এই দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। কারো কারো মতে চালের এই ঊর্ধ্বগামী লাগাম যদি টেনে ধরা না যায়, তবে একশ টাকায় গিয়ে ঠেকবে।

এভাবে চালের দাম বৃদ্ধির ফলে জন সাধারণের মাঝে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের প্রতি এ নিয়ে বাড়ছে ক্ষোভ। ক্রেতারা বলছে, গত তিন মাস আগে যে চাল ছিলো ৪০ টাকা করে তা বেড়ে গিয়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৭০ টাকায়! বিশেষজ্ঞদের মতে, চালের বাজারের এই অস্থিরতা সরকারের জন্য অশনিসংকেত। তবে এ পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এ নিয়ে সরকার সংশ্লিষ্টদের মাথাব্যথা নেই। তারা কেবল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বলেই যাচ্ছেন দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণের চাল মজুদ আছে। এরপর তাদের যেন আর কোনো কাজ নেই। সব মাথাব্যথা যেন আম-জনতার!

এর মধ্যে সরকার চাল আমদানিতে শুল্কও কমিয়েছে। সে-ও এক বা দুই শতাংশ নয়, একেবারে ২৮ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। তারপরও এই অস্থিরতা সৃষ্টির নেপথ্য কারণ কী হতে পারে? এ প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর আমাদের যেমন জানা নেই, সরকার সংশ্লিষ্টরাও এর সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারছে না। কিন্তু এ অবস্থা চলতে থাকলে খেটে খাওয়া মানুষজন কোন্ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন (?) সরকার সংশ্লিষ্টরা একবারও কী সেটি ভেবে দেখছেন না!

দেশে পর্যাপ্ত চালের মজুদ থাকা সত্ত্বেও উত্তরের শস্যভাণ্ডারখ্যাত ধানের জেলা দিনাজপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলেই চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে থেকে আমদানি ও মজুদ সত্ত্বেও বেড়েই চলেছে চালের দাম। অব্যাহতভাবে চালের দাম বাড়ায় মিল মালিকদের কারসাজি ও সিন্ডিকেটকেই দায়ী করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা বলছে সরকার সংশ্লিষ্টদের সঠিক তদারকি না থাকার কারণে এই অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন মিলে ও আড়তদারদের কাছে পর্যাপ্ত চাল মজুদ রয়েছে। সরকার পক্ষ থেকে সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় তারা যাচ্ছেতাই ভাবে চালের মূল্যবৃদ্ধি করে চলেছে। বিশেষজ্ঞমহল থেকেও একই মত ব্যক্ত করা হয়েছে।

খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম
খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম

এদিকে চাল আমদানিতে শুল্ক কমানোর ফলে প্রতিদিনই ভারত থেকে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ১৩০ থেকে ১৫০ টি করে চাল বোঝাই ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। যা গড় হিসেবে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ হাজার মেট্রিকটন চাল ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছে। এছাড়া থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমার থেকে চাল আমদানির চুক্তি করেছে সরকার। ইতোমধ্যে ভারত ও ভিয়েতনামসহ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানির চাল এলেও বাজারের অস্থিরতা কিছুতেই কাটছে না। বরং সপ্তাহ ব্যবধানে চালের দাম বেড়েই চলেছে। খাদ্যমন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের মতে, বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের সঠিক তদারকি না থাকায় চালের বাজারে এই অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল আমদানি হচ্ছে, ইতোমধ্যে ভিয়েতনামের এক লাখ ৫৪ হাজার টন চাল গোডাউনে ঢুকেছে। বাকি চাল খালাসের অপেক্ষায় সমুদ্রে আছে। কম্বোডিয়া থেকে আড়াই লাখ টন চাল আমদানিতে চুক্তি হয়েছে। এলসি হয়েছে, তিন মাসের মধ্যে এসব চাল দেশে আসবে।’ মন্ত্রীর কথায় এটুকু প্রতীয়মান, দেশে চালের কোনো সংকট নেই। আমরাও মনে করি নেই। তারপরও এভাবে চালের বাজারে চাল নিয়ে চালবাজির হেতু কী, কারা এর নেপথ্যে?

চালবাজির নেপথ্যে যারাই থাকুক না কেন, তাদের খুঁজে বের করা দায়িত্ব সরকার সংশ্লিষ্টদের। চাল নিয়ে মানুষের মনে যে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছে তা এখনই প্রশমিত করা না গলে আগামী দিনে তা দাবানলের মতোই জ্বলে ওঠবে। তখন সরকার বেকায়দায় পড়বে এতে কোনো ভুল নেই। হতে পারে কোনো একটি পক্ষ সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোর জন্য চালের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে চলেছে। সেটি কোন্ পক্ষ তা আমাদের জানার কথা নয়। তবে এটুকু জানি, চালবাজির নেপথ্যে যে পক্ষই থাকুক, সরকার অপেক্ষায় তারা বেশি ক্ষমতাধর নয়। তাই চাল বাজারের এই অস্থিরতা কমাতে কালক্ষেপন না করে সরকারের উচিত এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

বাজারে বাজারে এখনই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিশেষ মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা জরুরী বলেই মনে করছি। এছাড়াও জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন স্তরে সরকার তরফ থেকে বিশেষ নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে ভ্রাম্যমান আদালতের ব্যবস্থা করাও জরুরী। চালের এই মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা অত্যাবশ্যক। নয়তো বা চাল বাজারের এই অস্থিরতা সরকারকে ভালোভাবেই ভোগাবে। কেননা, চাল নিয়ে যা চলছে তা তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠছে সাধারণ মানুষ। আবার চালের বাজারে অস্বাভাবিক মৃল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে না পারার ব্যর্থতার দায় গিয়ে পড়ছে সরকারের ওপরে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)