চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

চাল নিয়ে এক চিলতে

চালের বাজারের হালচাল নিয়ে মিডিয়ায় আসা প্রতিদিনকার খবর সাধারণ মানুষের হতাশাকে এখনো দমাতে পারেনি। হঠাৎ চালের দাম বেড়ে যাওয়ার পিছনে বিশেষ মহলের ‘চালবাজি’ রয়েছে কীনা তা স্পষ্ট না হলেও হাওর অঞ্চলে সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং ব্লাস্টের আক্রমণকে চালের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পিছনে বড় কারণ বলে ধরে নেয়া যায়।

বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা ব্যহত হওয়া সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ও ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে না পারার কারণে চালের বাজারে ধস নেমেছে বলে অনেকের ধারণা। যারা নিয়মিত চাল কিনতে বাজারে যান, চালের দামের ঊর্ধ্বগতি, তাদের মন মেজাজের উপর কতটা প্রভাব ফেলছে, মিডিয়া রিপোর্টে তার ছিটেফোঁটা উঠে আসলেও প্রকৃত অবস্থাটা ঠিকই টের পাওয়া যায় ভুক্তভোগী মানুষের সঙ্গে কথা বললে। চালের দাম কেবল কিনে খাওয়া মানুষের উপর চাপ বাড়ায়নি, সরকারের উপর দায়িত্বের চাপও বাড়িয়ে দিয়েছে ।

মাঠ পর্যায়ে যারা কৃষক, সাম্প্রতিক চালের বাজার তাদের মন মেজাজের উপর কী ধরণের প্রভাব ফেলেছে, চলুন তার একটু খোঁজ-খবর নেয়া যাক।

কৃষি কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এমন কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে গতকাল কথা বলে ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। চালের মূল্যবৃদ্ধি যখন দেশের অধিকাংশ মানুষের কপালের ভাঁজকে আরো স্পষ্ট করে দিয়েছে, তাদের হতাশাকে বাড়িয়ে দিয়েছে সাংঘাতিক ভাবে; এমনকি, খোদ সরকারকেও যথেষ্ট চাপে ফেলেছে, তখন এই কৃষকদের মুখে শোনা যাচ্ছে উল্টো কথা। আনন্দের কথা।

ধানের দাম পেয়ে খুশি কৃষকরা

ধান চালের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধিতে তারা যারপরনাই খুশি। দারুণ খুশি।

মণ প্রতি এগারোশ থেকে সাড়ে এগারোশ টাকা দরে ধান বিক্রি করতে পেরে এবার অন্তত চাষবাসের খরচ উঠাতে পেরেছেন বলে তাদের আনন্দের যেন সীমা নেই। এমনিতে, বরাবর কৃষিকাজে উৎপাদন খরচ যা হয়, ফসল বিক্রি করে তার অর্ধেকও ফেরত আসে না। খরচাপাতি বেশি হওয়ায় তাদের অনেককেই অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। ঋণগ্রস্ত হতে হয় প্রায় প্রতিবছর। ফি-বছর এ ঋণের পরিমাণ কেবল বাড়ে। শোধরানোর কোন উপায় থাকে না।

তবুও কৃষি কাজের সঙ্গে এখনো যারা মাটি কামড়ে জড়িত আছেন, তা কেবল বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধারণ করেই।

বলাবাহুল্য, পশ্চাদপদ কৃষি ব্যবস্থা, অতিরিক্ত কৃষি খরচ আর উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় এদেশের কৃষকদের প্রায় সবাই বিপর্যস্ত। অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে কুঁজো অবস্থায় দিনাতিপাত করছে এই কৃষকেরা। সরকার কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে যতই বাগাড়ম্বর করুক, কৃষি বিপ্লবের কেচ্ছা শোনাক; দেশের অধিকাংশ কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এখনো ভয়াবহ রকমের খারাপ।

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের সাখুয়া মধ্যপাড়ার মধ্য বয়স্ক কৃষক মোঃ আলালুদ্দিন। নিজের সামান্য জমিতে ফসল উৎপাদন করে তার সংসার চালাতে হয়। সাম্প্রতিক ধান চালের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তিনি নিজের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘বাপ-পুত মিলে ক্ষেতে কাজ করেও ফসল ফলানোর খরচ কমাতে পারি না। বীজ, সার ও কীটনাশকের যা দাম, এর পরেও সবকিছু মিলিয়ে যে ধান পাই, তা দিয়ে কোন মতেই পোষে না। সংসার চালানো যায় না। তবে, এবারের মত যদি ধানের ভালো দাম পাওয়া যায়, তাহলে কৃষিকাজ করে খেয়েপুরে বেঁচে থাকা যাবে।’

ধান শুকানোর কাজে ব্যস্ত কৃষক

তারুন্দিয়া ইউনিয়ন কৃষক লীগের সভাপতি মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘কামলা খাটিয়ে আমার কৃষি জমিতে চাষাবাদ করতে অনেক খরচ হয়ে যায়। আনুসঙ্গিক অন্যান্য খরচ করে ফসল যা পাই, উদ্বৃত্ত ফসল বিক্রি করে তা মোট খরচের তুলনায় সামান্যই। তবুও বাপ-দাদার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছি। প্রতিবছর অনেক লোকসান সত্ত্বেও কৃষিকাজ করতে হচ্ছে। তবে, এছরের বাজার দরে আমি বেশ খুশি।’

তার ভাষায়: এই মৌসুমে লসের কোন কারণ নেই। আল্লাহর রহমতে এই বছর রিটার্ন ভালো পেয়েছি।

কৃষকরা যাতে কৃষিকাজ করে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, এ ব্যাপারে সরকারের জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে বলে সিরাজুল ইসলাম মত দেন। কৃষি উপকরণের দাম কমানোসহ সহজ শর্তে কৃষি ঋণ দেওয়ার দাবী করেন তিনি।

পার্শ্ববর্তী গ্রামের বর্গাচাষী মোঃ সিদ্দিকুর রহমান ধান চালের বর্তমান বাজার দরে বেজায় খুশি। তার ভাষায়, ‘আরেক জনের জমি চাষ করে, নিজের গতর খাটিয়ে যা পাই, তা দিয়ে কখনোই পোষাতো না। তবে, এবারের পরিশ্রম ওসুল হয়েছে। ধানের দর ভালো থাকলে, কৃষি কাজ করে আনন্দ পাওয়া যায়।’

এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারী ফার্মে চাকরীরত মোঃ সিদ্দিকুর রহমান যিনি ময়মনসিংহ শহরে সপরিবার বাস করছেন, চালের বর্তমান বাজার দরে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন। মাসের মোট চালের হিসাব অনুযায়ী তার চাল কেনাবাবদ খরচের কথা বলতে গিয়ে তিনি বেশ সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। চালের দাম কমানোর জোর দাবী জানিয়েছেন তিনি। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারকে পরামর্শও দেন এই চাকরিজীবী।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)

ছবি- জাকির সবুজ