দেশে চালের অন্যতম একটি বড় মোকাম কুষ্টিয়া। একটি শীর্ষ দৈনিক জানাচ্ছে জেলা প্রশাসনের হুশিয়ারি সত্ত্বেও ৯ সেপ্টেম্বর শনিবার কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকামে মিনিকেট চাল কেজি প্রতি বিক্রি হয়েছে ৫৬ টাকায়। ঈদের আগে যে চাল বিক্রি হয়েছে প্রতিকেজি ৫৪ টাকায় অর্থাৎ ২ টাকা কমে। বুঝা যাচ্ছে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে কেজি প্রতি চাউলে দাম বেড়েছে গড়ে দুই টাকা। শুধু মিনিকেট নয়, নাজিরশাইল, কাজললতা, বিআর আটাশ সব ধরনের চাউলের দামই গড়পরতায় বেড়েছে। মফস্বলে চাউলের দাম বৃদ্ধির এই সংবাদ মোটেও সরকারের জন্যে সুখকর বিষয় হতে পারে না। মফস্বলে দাম বৃদ্ধি মানেই রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় নগরীতে আরো বৃদ্ধি পাওয়া। শুধু কুষ্টিয়া নয়, চাউলের মোকাম দিনাজপুর, শেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নরসিংদী সবখানেতেই দাম বেড়েছে।
চাউলের বাজার বেশ কিছুদিন ধরেই অস্থিতিশীল। ধারাববাহিভাবে চাউলের দাম বেড়েই চলেছে। তবে এ বছরে সেই অস্থিতিশীলতা যেনো তুঙ্গে উঠেছে। বছরের শুরুতে চাউলের দাম বৃদ্ধি পেতে থাকে। এখন পর্যন্ত সেই ধারাবাহিকতা যেনো বিরাজমান। সর্বশেষ গতকাল ঢাকার মোহাম্মদপুর টাউন হলের খুচরা বাজারেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে চাউলের দাম বেড়েই চলেছে। টাউন হল চাউলের বাজারের অন্যতম অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান। তিনি বিসমিল্লাহ রাইস স্টোরের স্বত্ত্বাধিকারী। চাউলের বাজারের নাড়িনক্ষত্র তিনি বুঝেন। তাঁর দেওয়া সর্বশেষ তথ্য মতে, ভালো মানের মিনিকেট এখন বিক্রি করছেন প্রতিকেজি ৬০ টাকা দরে। তবে কোয়ালিটি অনুযায়ী প্রতিকেজি মিনিকেটের দাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে রয়েছে। একইভাবে প্রতিকেজি নাজিরশাইল চাউল বিক্রি করছেন ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে। বিআর আটাশ চাউলের দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে রয়েছে বলে জানান। আনিসুর রহমানের দোকানে সবচেয়ে কম দামের চাউল হলো গুটি স্বর্ণা, প্রতিকেজি বিক্রি করছেন ৪৪ টাকা দরে। মূলত সাশ্রয়ের লক্ষ্যে নিম্ন আয়ের মানুষেরা এই ধরণের মোটা চাউল বেশি ক্রয় করে থাকেন।
চাউলের দাম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ী আনিসুর রহমানসহ অন্যান্য বিক্রেতাদেরও এখন এক বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। পরিচিত কাস্টমার এলে তাঁদেরকে বিবিধ প্রশ্নের জবাব দিতে হয়। তাঁর মতে, দাম বাড়লে কাস্টমারদেরকে বুঝানো অনেক কষ্ট হয়ে পড়ে। অনেকে বিশ্বাস করতেও চায় না। অনেকে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রাগ করেন। সরকারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেন। চাউলের দাম প্রতিনিয়ত যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে করে চাউল ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান নিজেও এখন শঙ্কিত। নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা টেনে জানান প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি চালের ব্যবসা করেন, কিন্তু এভাবে ধারাবাহিকভাবে কখনই চাউলের দাম বাড়তে দেখেননি। বিষয়টি তাঁর কাছেও বিস্ময়কর বটে। তাঁর মতে মাত্র এক বছর আগেও তিনি নিজ দোকানে দাঁড়িয়ে গর্বভরে বলতেন এই সরকারের আমলে চাউলের দাম সেভাবে বাড়েনি। কিন্তু এখন আর সেই কথাটি বলতে পারেন না। বরং উল্টো শঙ্কায় থাকেন এই মনে করে যে ফের দাম বাড়লে ক্রেতাদের কাছে কী কৈফিয়ত দেবেন।
চালের দাম কেন বাড়ছে? কুষ্টিয়ার মিলমালিকরা রাখঢাক না করে বলেছেন বাজারে ধানের সঙ্কট থাকার কারণেই চাউলের দাম বেড়েছে। এই অভিযোগ বলে, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে পর্যাপ্ত ধান নেই। চাউলের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ধানের অপর্যাপ্ততা। তবে অনেকেই মনে করেন মিল মালিকদের এই অভিযোগ অসত্য নয়। মিল মালিকদের কাছে বড় ধরনের চালের মজুত রয়েছে। অবশ্য খুচরা বিক্রেতারাও তাই মনে করেন। এর আগে অবৈধ চাল মজুত, সিন্ডিকেট গঠন, খাদ্যগুদামে চাল সরবরাহ না করে সরকারকে অসহযোগিতা করার অভিযোগে ১৬ হাজার মিল মালিককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
এদিকে চাউলের দাম কমিয়ে আনতে সরকার কিছু প্রচেষ্টা গ্রহণ করলেও তাতে খুব কাজ হয়েছে বলে দৃশ্যমান নয়। প্রথমত কিছুদিন আগে সরকার বাজার সচল এবং স্থিতিশীল রাখতে চালের আমদানী শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে মাত্র ২ শতাংশতে নামিয়ে নিয়ে আসে। আমদানী সুগম করতেই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। আবার সরকারের পক্ষ থেকেও কিছু দেশের সাথে চুক্তিও করা হয়। সর্বশেষ খাদ্যমন্ত্রী মায়ানমারের সাথে একটি চুক্তি সম্পন্ন করে এসেছেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলো বলছে, সরকারের কাছে চালের মজুদ খুব একটা ভালো নেই। সরকারের কাছে এখন পর্যন্ত চালের মজুত মাত্র ৩ লাখ ২১ হাজার টন। ১৫ লাখ টন চাল আমদানীর টার্গেট করলেও গত তিনমাসে সরকারি গুদামে সরকারের পক্ষ থেকে চাল তুলতে পেরেছে মাত্র ১ লাখ ২৭ টন। গবেষকদের মতে, সরকারের কাছে ৬ লক্ষ টনের কম চাল মজুদ থাকলেই বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই।
চালের দাম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাওয়ায় কারণে সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষেরা। গ্রাম বা শহর সবখানের শ্রমজীবী মানুষেরই উপরই এটি একটি বাড়তি চাপ হিসেবে যুক্ত হয়েছে। একজন শ্রমজীবী বা দিনমজুর মানুষকে গত বছরের তুলনায় অন্তত গড়ে ১০ থেকে ১২ টাকা বেশি দিয়ে প্রতিকেজি চাউল ক্রয় করতে হচ্ছে। যে পরিবারে প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৪ কেজি চাউল লাগে তাদেরকে গড়ে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা শুধু চাউল বাবদই বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। টাউন হলের
চাল ব্যবসায়ী আনিসুর রহমানও বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, গত বছর যে মোটা চাউল প্রতিকেজি তিনি টাউন হলে ৩২ টাকা থেকে ৩৩ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন সেই চাল এখন বিক্রি করছেন ৪২ থেকে ৪৪ টাকা। আনিসুর রহমান তাঁর পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, চাউলের দাম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতারা বিষয়টি একদমই ভালোভাবে নিচ্ছেন না। বরং দোকানের সামনে দাঁড়িয়েই সরকারের তীব্র সমালোচনায় মুখর হন ক্রেতারা। তিনি মনে করেন চাউলের উর্ধ্বগতির মূল্যের বিষয়টি সামাল না দিতে পারলে সরকারকে আগামীতে চড়ামূল্য দিতে হবে।
চালের বাজারের এখন যে অবস্থা তাতে করে এটি স্পষ্ট যে, দাম কমার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই। সরকারের হাতেও আপাতত এমন কোনো ম্যাজিক নেই যে চাউলের দাম কমিয়ে আনতে পারবে। এ ছাড়া এ বছর হাওরের বিপর্যয় এবং সর্বশেষ বন্যায় ধানের যে বিশাল ক্ষতি হয়েছে সেটাও এখন পুষিয়ে নেওয়া কঠিন বিষয়। এই মুহূর্তে চাউলের বাজারে স্বস্তি এবং স্থিতিশীলতা আনাটা সরকারের কাছে অন্যতম এজেন্ডা হওয়া উচিত। চাউলের বাজার উর্ধ্বমুখী থাকলে কোনো উত্তরই জনগণ গ্রহণ করবে না। আর বারবার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে বলে সবকিছু জাস্টিফাই করাও সম্ভব হবে না। সুতরাং সময় থাকতেই সাবধান হওয়া বড় প্রয়োজন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)