চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

চার শিশু হত্যাকারী এক অমানুষের স্বীকারোক্তি

হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের ৪ শিশু হত্যার দায় স্বীকার করে গতকাল সন্ধ্যায় গ্রেফতারকৃত একজন ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কৌশিক আহমেদ খন্দকার এর আদালতে এ স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দেন রুবেল মিয়া।

স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দেয়া ঘাতক হচ্ছে- একই গ্রামের গ্রেফতারকৃত আব্দুল আলী বাগালের পুত্র রুবেল মিয়া। বুধবার তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে।

রাত সাড়ে ৮ টার দিকে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের নিকট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বর্ণনা দেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম, সহকারি পুলিশ সুপার মাসুদুর রহমান ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসি মোক্তাদির হোসেন।

সুন্দ্রাটিকি গ্রাম পরিদর্শন করেছেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। তিনি বলেন, ৪ শিশু হত্যায় জড়িতদের বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি নিহত প্রত্যেক শিশুর পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেন।

সূত্রমতে, এ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় ৬ ঘাতক । এর মধ্যে ৫ জনকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। রুবেল ছাড়া গ্রেফতারকৃত অপর ৪ জন হচ্ছে- আব্দুল আলী বাগাল, তার পুত্র জুয়েল মিয়া, একই গ্রামের আরজু মিয়া ও বশির মিয়া।

ঘটনার সঙ্গে জড়িত সিএনজি চালক বাচ্চু মিয়া লাশ উদ্ধারের দিন বিকেল পর্যন্ত এলাকায় অবস্থান করলেও বিকেল থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেউ বলছেন তাকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে। তবে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি।

যে কারণে হত্যার করা হয়

চ্যানেল আই অনলাইনের অনুসন্ধানে জানা যায়, সুন্দ্রাটিকি গ্রামে ৮টি পঞ্চায়েত রয়েছে। পঞ্চায়েতের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চলে প্রকাশ্য ও মৌন দ্বন্দ্ব। বাগান চৌকিদার আব্দুল আলী বাগাল চায় এককভাবে গ্রামের কর্তৃত্ব করায়ত্ব করতে। ইতিপূর্বে বাগান শ্রমিকদের সাথে সুন্দ্রাটিকি গ্রামের বাসিন্দাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

ওই সংঘর্ষের ঘটনাসহ বিভিন্ন কারণে খরচ মেটাতে গ্রামের প্রায় ২০ লাখ টাকার জায়গা বিক্রি করা হয়। বাগানের সাথে সংঘর্ষের ঘটনার সময় ওই টাকা থেকে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা ব্যয় করে গ্রামের মানুষকে খাওয়ানো হয়। বাকি টাকার প্রতি লোভ করে বাগান কর্মচারী পঞ্চায়েত সর্দার আব্দুল আলী বাগাল।

ইতিমধ্যে আব্দুল আলী বাগাল লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বাকী টাকাগুলোও তার চাই। গ্রামের বড়ই গাছের ডাল কাটা নিয়ে প্রায় ১ মাস পূর্বে সংঘর্ষের ঘটনার পর থেকেই তারা এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা নেয়। এ কারণে শিশুদের হত্যা করে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পরিকল্পনা করে আব্দুল আলী বাগাল ও তার সহযোগিরা।

যে ভাবে হত্যা করা হয়

গত ১২ ফেব্রুয়ারি বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর গ্রামে ফুটবল খেলা দেখে বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করছিল চার শিশু। এ সময় একই গ্রামের সিএনজি চালক বাচ্চু তার সিএনজিতে তুলে সুন্দ্রাটিকি গ্রামের মোঃ ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), তার দুই চাচাতো ভাই আব্দুল আজিজের ছেলে তাজেল মিয়া (১০) ও আবদাল মিয়ার ছেলে মনির মিয়া (৭) এবং তাদের প্রতিবেশী আবদুল কাদিরের ছেলে ইসমাঈল হোসেন (১০) কে নিয়ে যায় তার গাড়ির গ্যারেজে।

তাদের সিএনজিতে তুলে নিয়ে যাবার সময় একই গ্রামের আহাদ মিয়া নামে এক ব্যক্তি দেখেছে বলে নিহত এক শিশুর পিতা আব্দাল মিয়া জানান। অবশ্য আহাদ মিয়া পরে আর স্বীকার করছে না। পরে ঘাতকরা চেতনা নাশক ঔষধ দিয়ে তাদেরকে অজ্ঞান করে গ্যারেজে ফেলে রাখে। শুক্রবার রাতেই শ্বাসরোধে তাদের হত্যা করে। শুক্রবার মাঝ রাতে বস্তাবন্দি করে নিহত ৪ শিশুকে ওই স্থানে মাটি চাপা দেয়।

সূত্র জানায়, যে স্থানটিতে মাটি চাপা দেয়া হয় সেই স্থানে বালু উত্তোলনের তদারকি করতো সেলিম নামে এক ব্যক্তি। সেলিম হচ্ছে ঘাতক আব্দুল আলী বাগালের প্রতিপক্ষ পঞ্চায়েতের লোক। তাই সেলিমসহ প্রতিপক্ষের লোকজনকে ফাঁসানোর জন্যই লাশগুলো পুতে রাখার জন্য ওই স্থানটি নির্বাচন করে।

এদিকে খেলা শেষে বাড়ি ফিরে না আসায় আত্মীয় স্বজনসহ বিভিন্ন স্থানে সন্ধান করেও তাদের পাওয়া যায়নি। পরদিন পরিবারের পক্ষ থেকে বাহুবল থানায় একটি জিডি এবং গত মঙ্গলবার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা দায়ের করা হয়।

নিখোঁজের ঘটনার ৫ দিন পর গত বুধবার সকালে গ্রামের পার্শ্ববর্তী ইছাবিল বালু মহালে মাটির নীচে পুঁতে রাখা এক শিশুর হাত দেখতে পায় মাটি কাটা শ্রমিকরা। পরে নিখোঁজ শিশুদের বাড়িতে খবর দিলে লোকজন ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। এসময় খবর পেয়ে বাহুবল থানা পুলিশ, র‌্যাব-৯, ডিবি পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মাটি খুড়ে পৃথক গর্তে রাখা ৪ শিশুর লাশ উদ্ধার করে।

এদিকে গতকাল এদিকে অপহরণের সময় ৪ শিশুকে বহনকারী সিএনজি অটোরিক্সা (হবিগঞ্জ-থ ১১-৩৬০৮)টি একই গ্রামের সিএনজি চালক বাচ্চু মিয়ার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বাহুবল থানার ওসি মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ গতকাল শুক্রবার বেলা ৩ টার দিকে সিএনজিটি উদ্ধার করে।

সুন্দ্রাটিকিতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি

নিহত ৪ শিশুর পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ ও সমবেদনা জানাতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি গতকাল বাহুবলের সুন্দ্রাটিকি গ্রামে আসেন। নিহত ৪ শিশুর পিতা-মাতার সাথে সাক্ষাৎকালে শিমুর মা মন্ত্রীকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাদের কান্না আর থামানো যাচ্ছিলো না।

এ সময় মন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকী, তার সাথে থাকা নবীগঞ্জ-বাহুবল আসনের এমপি এম এ মুনিম চৌধুরী বাবু এমপি, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, জেলা প্রশাসক সাবিনা আলম সহ অন্যান্যরাও চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি।

এ সময় মন্ত্রী নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সান্তনা দেন। পরে উপস্থিত শত শত উৎসুক জনতার উদ্দেশ্যে প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ৪ শিশুকে নির্মমভাবে হত্যার সাথে যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদের বিচারের সম্মুখীন করা হবে। অপরাধীদের বিচার করা হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। তিনি বলেন, পুলিশ মানুষের শান্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু একা পুলিশের পক্ষে শান্তিশৃংখলা বজায় রাখা সম্ভব নয়। কারণ দেশে গড়ে ১২শ লোকের জন্য ১ জন পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি না হলে সমাজ থেকে অপরাধ দূর করা কঠিন হয়ে পড়বে। যারা অন্যায় করে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

তিনি বলেন, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডসহ এর পেছনের তথ্য বের করা হবে। তবে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানী করা হবে না।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শিশু হত্যার বেদনায় ভুক্তভোগী। প্রধানমন্ত্রীর ভাই শিশু রাসেলকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলো এ হত্যার সাথে জড়িতদের বিচার না করে গলায় ফুলের মালামালা পড়িয়ে দেয়। যে কারণে এদেশে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটে।

তিনি বলেন, ৪ শিশু নিখোঁজের পর উদ্ধারে প্রশাসনের কোনো গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে ৪ শিশু হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার গ্রেফতারকৃত আব্দুল আলী বাগালের পুত্র রুবেল মিয়া, একই গ্রামের আরজু মিয়া ও বশির মিয়াকে গতকাল শুক্রবার কোর্টে হাজির করা হয়।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের সুন্দ্রাটিকি গ্রামের জাকারিয়া আহমেদ শুভ, তাজেল মিয়া (১০) ও মনির মিয়া (৭) এবং ইসমাঈল হোসেন (১০) নিখোঁজ হন। আত্মীয় স্বজন সহ বিভিন্ন স্থানে সন্ধান করেও তাদের পাওয়া যায়নি।

পরদিন পরিবারের পক্ষ থেকে বাহুবল থানায় একটি জিডি এবং গত মঙ্গলবার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা দায়ের করা হয়। নিখোজের ঘটনার ৫ দিন পর গত বুধবার সকালে গ্রামের পার্শ্ববর্তী স্থানে মাটির নিচে পুঁতে রাখা অবস্থায় নিখোঁজ ৪ শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।