আমাদের দেশের মানুষ বড় বড় কথা বলায় ওস্তাদ। আর এ ব্যাপারে রাজনীতিবিদরা সব সময় অগ্রগণ্য। শীত-গ্রীস্ম-বর্ষা-বসন্ত কোনো ঋতুতেই তাদের মুখ বন্ধ থাকে না। কোকিল কেবল বসন্তে গায়। কিন্তু আমাদের রাজনীতির ‘কোকিল’গণ বারো মাস গেয়ে যান, নানা কথা, নানা সুর, নানা বুলি। এসব কথা শুনে আমরাও বিনোদিত হই। আমাদের লড়াই-ঘেরা জীবনে নেতানেত্রীদের এসব কথা যেন জীবনীশক্তি হিসেবে কাজ করে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে শতকরা ৩০ ভাগ লোকও ভোটকেন্দ্রে যাননি। তারপরও ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কতই তৃপ্তির ঢেকুর। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ নির্বাচন, অনন্য নির্বাচন, পুরস্কার পাবার মতো নির্বাচন-এমন কত কিছু বলা হলো। এদিকে ব্যাংক-বিমা-শেয়ারবাজারসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তীব্র সংকট চললেও অর্থমন্ত্রী মহোদয় নিজের প্রশংসায় নিজেই পঞ্চমুখ। সম্প্রতি তিনি বিরোধী দলীয় এমপিদের সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমি যে বিশ্বের অর্থমন্ত্রীদের সেরা, এটা তাঁরা একবারও বলেননি’। অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে ‘বিশ্বসেরা অর্থমন্ত্রী’ না বলাটা অবশ্য ভারি অন্যায়। সমস্যা হলো, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মধ্যে তো অনেকেই অনেক কিছুতে ‘সেরা’। গুণে-কৃতিত্বে না হলেও চাপাবাজিতে তো বটেই। কারটা রেখে কারটা বলা হবে। বলবেই বা কে? সেরা, শ্রেষ্ঠ, চ্যাম্পিয়ন, তো ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া সম্পদ নয়, বিরোধী দলও এসব ব্যাপারে কম যায় না! এখন এক পক্ষ নিজেরাই যদি নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করেন, তাহলে তারা অন্যদের সেরা বলেন কীভাবে? অন্যের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিলে তো আর নিজের ‘সেরাত্ব’ থাকে না!
আসলে আমাদের দেশের মানুষ দুটি জিনিস খুব ভালো পারে। এর একটি হচ্ছে লড়াই আর অন্যটি হচ্ছে কথার বড়াই। এদেশের মানুষকে লড়াই করেই বেঁচে থাকতে হয়, টিকে থাকতে হয়। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই, রোগ-শোক-হতাশার বিরুদ্ধে লড়াই। পদ-পদবি-ক্ষমতা-দাপট-সুনাম-খ্যাতির জন্য লড়াই। অন্যের ষড়যন্ত্র-ফাঁদ থেকে রেহাই পেতে লড়াই, নিজের প্রবৃত্তি ও দুষ্ট স্বভাবের বিরুদ্ধে লড়াই। অন্যায়-অবিচার-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই। শব্দ-দূষণ-বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে লড়াই। নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুযোর্গের বিরুদ্ধে লড়াই। এমনি অসংখ্য লড়াই। রাজনৈতিক দলগুলো তাই স্লোগান দেয়, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই!’ আমাদের রাজনীতিবিদরা অবশ্য এখন খুব একটা লড়াই করেন না। তবে তারা যাদের জন্য লড়াই করার ঘোষণা দেন, সেই ‘জনগণ’ কিন্তু একা একা ঠিকই লড়াইটা চালিয়ে যান।
আমাদের দেশের মানুষ আরেকটি বিষয়ে খুবই দক্ষ-সেটি হচ্ছে কথার বড়াই করা। আমার দাদার হাতি ছিল, মামা বিরাট বড় সরকারি অফিসার, ছোট চাচা আমেরিকায় অনেক টাকা উপার্জন করেন, আমি অক্সফোর্ডে তিন তিনবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষ নির্বাচিত হয়েছিলাম, এমন বড়াইয়ের কোনো শেষ নেই। প্রচণ্ড মার খেয়ে যে মরতে বসেছে, সেও অস্ফূট স্বরে ঘোষণা করে, ‘তোকে দেখে নেব!’ গতরে শক্তি না থাকুক, ঘটে জ্ঞান না থাকুক, পকেটে টাকা না থাকুক, কিন্তু বড় বড় কথা বলার ক্ষেত্রে আমাদের জুড়ি নেই। কথার বড়াইয়ে পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশ ও জাতির তুলনায় নিঃসন্দেহে আমরা সেরা, এগিয়ে।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটি গল্প। সরাইখানায় জনাপাঁচেক সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রের বিষয় নিয়ে খুব হামবড়া ভাব দেখিয়ে গল্প করছিল। সেখানে যে লোকজন বসেছিল তারা হাঁ করে তাদের গল্প শুনছিল এবং মাঝেমধ্যে কথায় সায় দিচ্ছিল। তার মধ্যে একজন সৈন্য বলল, ‘আমি যখন একখানা মাত্র তলোয়ার নিয়ে শত্রুপক্ষকে খুব সাহসের সঙ্গে তাড়া করলাম, তখন ব্যাটারা পড়ি কি মরি করে প্রাণের ভয়ে যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল। পেছন ফিরে একবারও তাকাল না।’
আর একজন সৈন্য বলল, ‘একবার যুদ্ধ করতে করতে একসময় বন্দুকের গুলি ফুরিয়ে যায়। তখন আমি সেই গুলিবিহীন বন্দুকটি নিয়ে বিপক্ষ দলের দিকে হুঙ্কার দিয়ে সাহসের সঙ্গে এমন তাড়া করলাম যে বিপক্ষ দলের সৈন্যরা ভয়ে আধমরা হয়ে পাহাড় থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে মারা গেল সবাই। একটাও রইল না যুদ্ধ করার জন্য।’
ওই সময় হোজ্জা সাহেবও বসে বসে খাবার খাচ্ছিলেন। তিনি ভাবলেন, এই চাপাবাজির একটি জবাব দেওয়া দরকার। তাই কথার মাঝখানে হোজ্জা বেশ গম্ভীরভাবে বললেন, ‘আমি সেবার যুদ্ধে গিয়েছিলাম, সেই যুদ্ধে এক দুশমনের পা কেটে দিয়েছিলাম তলোয়ারের এক আলতো খোঁচায়।’
‘মাথা না কেটে পা কাটলেন কেন?’ একজন সৈন্য হোজ্জা সাহেবকে জিজ্ঞেস করল।
‘ইয়ে…আমি যার পা কেটেছিলুম, তার মাথাটা আগে থেকেই কাটা ছিল।’
কথার বড়াই করতে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষকেই কিছু মিথ্যে বলতে হয়। কেননা শুধু সত্য দিয়ে ‘বড়াই’ করার মতো পর্যাপ্ত উপাদান অধিকাংশ মানুষেরই থাকে না। সে দিক থেকে প্রত্যেক মানুষই কমবেশি মিথ্যা বলে। কেউ প্রয়োজনে বলে, কেউ আবার মনের আনন্দে বলে। তবে বিনা কারণে, বিনা প্রয়োজনে নির্বিকারভাবে মিথ্যা কথা বলে এমন লোক আমাদের সমাজে কম নেই। কেউ কেউ অহঙ্কার করার জন্য মিথ্যা কথা বলে। অফিসের বসরা যেমন বলে থাকেন, আমার চেয়ে ভালো ইংরেজি এ অফিসে একজনও জানে না। কিংবা কাজে ফাঁকি দেয়া আমার ডিকশনারিতে নেই।
আমাদের বন্ধু-বান্ধবরাও বিস্তর মিথ্যা বলে। অনেকেই আছে যারা বঙ্গবাজার থেকে আনকোরা এক মাল গায়ে চাপিয়ে বলে, এটা আমার আঙ্কেল নিউজার্সি বা আন্টি ‘এলে’ (লস-এঞ্জেলেস) থেকে পাঠিয়েছেন!
অনেকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অথবা জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জেরায় জর্জর হয়ে মিথ্যা কথা বলে। দেরি করে অফিসে পৌঁছে ঊর্ধ্বতনের কাছে, রাতে দেরি করে বাসায় ফিরে বউয়ের কাছে মিথ্যা কারণ দেখানোরও অনেকের প্রয়োজন পড়ে।
স্কুলের ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা মিথ্যা বলবে কিংবা অফিসে বসের কাছে কনিষ্ঠ সহায়ক অসত্য অজুহাত দেবে কাজ না করার, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বাড়ির কাজের লোক বাজার করে এসে সত্যি হিসাব দেবে, কিংবা লম্পট স্বামী স্ত্রীর কাছে সত্য বিবৃতি দেবে, এরকম আশা করাটাও অন্যায়।
এগুলোর তবু কার্যকারণ আছে। এসব মিথ্যা ভাষণের প্রয়োজন বোঝা কঠিন নয় এবং যে মিথ্যা বলছে তার কাছে এর প্রয়োজনও রয়েছে। কিন্তু এর বাইরে এক ধরনের প্রয়োজনহীন মিথ্যা কথা আছে। মনের আনন্দে নির্দ্বিধায় উল্টোপাল্টা ডাইনে-বাঁয়ে মিথ্যা বলা অনেকের স্বভাব এবং বলতে না পারলে তারা দম বন্ধ হয়ে পেট ফেটে মরে যাওয়ার অবস্থায় পৌঁছে যায়। ডাকটিকেট জমানো ও পুরনো মুদ্রা সংগ্রহের মতো অনেকের হবি হচ্ছে মিথ্যা বলা। তবে এসব মিথ্যা খুবই সাধারণ এবং নির্দোষ। এ ধরনের মিথ্যা কারও কোনো ক্ষতির কারণ হয় না। স্রেফ গল্প দেয়ার জন্যই তারা এ ধরনের মিথ্যা চর্চা করে থাকে। যেমন কবে কোথায় কোনো মেয়ে তার প্রেমে পড়েছিল, কবে একদিন একাই দুই ছিনতাইকারীকে পাকড়াও করেছিল- এসব মিথ্যাচার কারও কোনো ক্ষতির কারণ হয় না। তবে সব ধর্মেই এ কথা বলা আছে- মিথ্যা বলা মহাপাপ। এই আপ্তবাক্য অবশ্য মিথ্যুকদের সত্য কথা বলার ক্ষেত্রে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি। সুযোগসন্ধানীরা স্বার্থ-সুবিধা ও প্রয়োজনমতো ঠিকই মিথ্যা চর্চা অব্যাহত রেখেছে।
বর্তমান জমানায় চারদিকে মিথ্যারই জয়জয়কার। বর্তমানে শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, প্রেমিক-প্রেমিকা, পুলিশ, আমলা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রীরা তো মিথ্যা বলেনই; এমনকি ধর্মগুরুরা পর্যন্ত মিথ্যা কথা বলেন। তবে মিথ্যা বলার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা আপসহীন ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন। স্বার্থ হাসিলের জন্য, দায় এড়াতে (পিঠ বাঁচাতে) এবং প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এমন মিথ্যা চর্চা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কেউ কখনও করেছে কিনা সন্দেহ।
যারা দুর্নীতি করেছেন, তারা বলেন আমি নির্দোষ। যারা জঙ্গি সৃষ্টি করছেন, তাদের মদদ দিয়েছেন, তারা বলেন, না ওসব মিথ্যা কথা। আমি মহান। কেউ তার অপরাধ স্বীকার করেন না, হাতেনাতে ধরা পড়লেও না। যাদের যা করার কথা তারা তা করেন না। অথচ নিয়মিত প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিলে অস্বীকার করে বসেন। এভাবে মিথ্যা আর অসত্যের চাদরে সব কিছুকে ঢেকে ফেলা হয়েছে। সবাই যেন মিথ্যা বলার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কেউ সত্য কথা বলছেন না। তারা অবশ্য মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিতও করতে পারছেন না। আজকের মিথ্যাকে আগামীকালই সত্য হিসেবে কবুল করছেন। তারপর শুরু করছেন নতুন করে মিথ্যাচার।
প্রশ্ন হলো, এই শ্রেণির মানুষরাই কী যুগ যুগ ধরে আমাদের নেতা হয়ে থাকবেন?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)