একটি দরিদ্র পরিবারকে ছোট্ট একটি সাহায্য করতে গিয়ে যেন জীবনটাই পাল্টে গেল লিউক মিকেলসনের। অনেক টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে এখন তিনি ‘ঘুমের কারিগর’। ছোট ছোট শিশুদের মুখে হাসি ফোটানোই তার কাজ।
২০১২ সালে লিউক ও তার পরিবার জানতে পারলেন স্থানীয় একটি পরিবারের কথা। পরিবারটি এতই দরিদ্র যে সেখানকার বাচ্চারা মেঝেতে ঘুমাত। এ কথা শুনে লিউক ও তার পরিবার নিজ থেকেই একটি বাংক বেড (দোতলা ছোট বিছানা) তৈরি করে দরিদ্র পরিবারটিকে দান করেন।
‘সেখানে একটি বাচ্চা মেয়ে ছিল যার বিছানা ছিল শুধু এক গাদা পুরনো কাপড়চোপড়। দেখে মনে হয় যেন ছোট একটা পাখির বাসা। ওখানেই মেয়েটা ঘুমাত। যখন আমরা ওর জন্য নতুন বিছানা বানিয়ে নিয়ে গেলাম বাচ্চা মেয়েটা খুশিতে সেটাকে জড়িয়ে ধরল, আর ছাড়তেই চাইছিল না,’ আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন লিউক।
ঠিক সেই সময়ই লিউক আবিষ্কার করলেন শুধু এই একটি পরিবার নয়, এমন আরও অসংখ্য দরিদ্র পরিবার রয়েছে, অর্থাভাবে যেখানকার শিশুদের ঘুমানোর একটি স্বাভাবিক জায়গা পর্যন্ত নেই।
বেশ ঘনিষ্ঠ একটি জনগোষ্ঠীতে পরিবারসহ লিউকের বসবাস। তাই সেখানকার ক্ষুদে অধিবাসীদের কষ্টের কথা জানতে পেরে হতবাক হয়ে যান তিনি। বলেন, ‘আমার চোখ খুলে গিয়েছিল। আমি চুপচাপ বসে ভাবছিলাম, সত্যিই কি এতগুলো মানুষের এমন খারাপ অবস্থা চলছে?’
এরই ধারাবাহিকতায় লিউক প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্লিপ ইন হেভেনলি পিস’ (স্বর্গীয় প্রশান্তিতে ঘুমাও) নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যা দরিদ্র ও চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য বিছানা তৈরি করে সরবরাহ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহোতে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ৪১ বছর বয়সী লিউক মিকেলসনের। হাই স্কুলে ফুটবল টিমের জনপ্রিয় কোয়ার্টারব্যাক ছিলেন। সেখান থেকে কর্মক্ষেত্রে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার। একই সঙ্গে ছোট বাচ্চাদের বেশ কিছু স্পোর্টস টিমকে কোচ করতেন আর অবসর সময়ে মাছ ধরতে যেতেন নদীতে। নিয়মিত প্রার্থনাও করতেন চার্চে গিয়ে।
এমন একটি বহুল কাঙ্ক্ষিত জীবনযাত্রা তার মোড় নিলো ভিন্ন দিকে, যখন লিউকের নতুন একটি উপলব্ধি হলো।
‘আমি আসলে বুঝতেই পারছিলাম না তাদের বড় চাহিদা আসলে কোনটা,’ সিএনএন’কে এক সাক্ষাতকারে বলেন লিউক, ‘প্রতিবেশী পরিবারগুলোতে বাবামায়েরা বাচ্চাদের জন্য টেবিলে খাবার, গায়ে কাপড় বা মাথার ওপরে ছাদ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে বিছানা নিছক বিলাসিতা ছাড়া কিছু না।’
কিন্তু ছোট ছোট শিশুদের কষ্টের বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলেন না তিনি। তাই যথাযথ সেফটি গাইডলাইন এবং নিজের মেয়ের বাংক বেডের নকশাকে অনুসরণ করে নিজেই কাঠ ও অন্যান্য সরঞ্জাম কিনে নিজের টাকা দিয়েই ছোট ছোট বিছানা বানাতে শুরু করেন লিউক। ছুটির দিনগুলোতে এ কাজে সাহায্য নিতের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের।
অল্প সময়ের মধ্যেই লিউক মিকেলসনের এই উদ্যোগের কথা ছড়িয়ে পড়ল। নিজের এবং আশপাশের কমিউনিটি থেকে আসতে থাকল আগ্রহী লোকজনের উৎসাহ ও আর্থিক সহায়তা। এগিয়ে যেতে থাকল দাতব্য বিছানা তৈরির কাজ।
বর্তমানে আনুষ্ঠানিকভাবে অলাভজনক দাতব্য সংস্থাটির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন লিউক। সেখানে প্রশিক্ষণ দেয়া থেকে শুরু করে বিছানা তৈরির ম্যানুয়েল, এমনকি লোকাল চ্যাপটারও খোলা হয়েছে যেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ এই প্রচেষ্টায় অংশ নিতে পারে।
লিউক জানান, “আমাদের শহরে একটি শিশুও মেঝেতে ঘুমাবে না” মূলমন্ত্র নিয়ে কাজ করছে স্লিপ ইন হেভেনলি পিস। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি পুরো আমেরিকা জুড়ে ৬৫টিরও বেশি চ্যাপটার গঠন করেছে এবং দেড় সহস্রাধিক বিছানা তৈরি করে সরবরাহ করেছে।
কিন্তু দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কাজ দ্রুত বাড়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে লিউকের জটিলতা। কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হলেন তিনি: হয় ক্যারিয়ার ধরে রাখতে হবে, নয়তো অলাভজনক সেবামূলক কাজটি চালিয়ে যেতে হবে। লিউক পরেরটাই বেছে নিলেন। সাথে সাথেই ‘অনেক টাকা’ থেকে ‘শূন্য টানা’ আয়ের স্তরে চলে গেলেন তিনি।
‘আমি আবিষ্কার করলাম যে, আমার চাহিদাটা আসলে আর্থিক নয়। চাহিদাটা হলো ছোট ছোট শিশুর মুখে হাসি আর আনন্দ দেখে অনুভব করা যে আমিও কারও জীবনে পরিবর্তন আনতে পারি।’
তারপর থেকে আর লিউককে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।