ষোড়শ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরষ্কৃত ও ব্যাপক প্রশংসিত হলো বাংলাদেশের ৯৮ মিনিটের চলচ্চিত্র হালদা। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছিল জেলে জীবনের আখ্যান। যুগ যুগ ধরে চলে আসা শোষণ বঞ্চনা, মহাজনী অপতৎপরতা আর তৃণমূলের জীবন বাস্তবতার এক গভীর চিত্র। সেটি পদ্মা পাড়ের জনবসতির অনিবার্য জীবনপ্রবাহ। যেখানে দর্শক আবিষ্কার করে নদীপাড়ের রক্তচোষা শ্রেণীকে। যেখানে জীবনের গল্প হয়ে ওঠে মেহনতি মানুষের সংগ্রামের কথকতা।
কিন্তু এবার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কথা বলে উঠলো নদী। বাংলাদেশ ও বাঙালির গর্ব আর আশীর্বাদের এক স্রোতপ্রবাহ হালদা নদী। পৃথিবীতে অনন্য এক নদী। যেখানে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে। যুগ যুগ ধরে রুই কাতলার আদি জাত সংরক্ষণ ও বংশবিস্তার প্রক্রিয়ার ভের শুদ্ধতা টিকিয়ে রেখেছে এই হালদা। আমরা যদি প্রাকৃতিক উৎসের সুস্বাদু মাছের কথা ভাবতে চাই তাহলে হালদা নদী হয়ে ওঠে অবিকল্প।
বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের বিপ্লবী সূত্রধর শাইখ সিরাজ বহু আগেই দেশবাসীকে জানান দিয়েছেন হালদা নদীর গুরুত্ব। তিনি বছরের পর বছর চিহ্নিত করেছেন হালদার দুশমনগুলো। চট্টগ্রাম মহানগরীর বর্জ্যমেশানো পানি এসে হালদার পানিকে করে চলেছে বিষাক্ত। প্রতি বছরই শুরু হয় হালদার বুক থেকে অপরিকল্পিত বালি তোলার প্রতিযোগিতা। হালদা নদীর বাকগুলো কাটা হয় নির্দয়ভাবে। হালদা পাড়ে বছরের পর বছর ধরে মাটি পুড়িয়ে তৈরি করা হয় ইট। হালদার আকাশ বাতাস থাকে ইট পোড়ানো উত্তাপ, দূষণ সৃষ্টিকারী নানা উপাদানে ভারাক্রান্ত। হালদা নদীর বেশ কয়েকটি স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে অপরিকল্পিত স্লুইচ গেইট। এখানেই শেষ নয়, হালদা নদীকে হত্যা করে সেচ সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি আবাদ বৃ্দ্ধির লোক দেখানে সরকারি তৎপরতাও দেখা গেছে। অথচ হালদার জীবনপ্রবাহ অন্যরকম।
প্রতিবছর হালদা নদীতে একটি বিশেষ মুহূর্তে ও বিশেষ পরিবেশে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস ও কার্প জাতীয় মাতৃমাছ প্রচুর পরিমাণ ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়কে “তিথি” বলা হয়ে থাকে। মা মাছেরা এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত শুধু অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথিতে অনুকূল পরিবেশে ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার এই বিশেষ সময়কে স্থানীয়রা “জো” বলে। এই জো এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা হতে হবে, সেই সাথে প্রচণ্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত হতে হবে;- এই বৃষ্টিপাত শুধু স্থানীয়ভাবে হলে হবে না, তা নদীর উজানেও হতে হবে। ফলে নদীতে পাহাড়ী ঢলের সৃষ্টি হয়। এতে পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনাকারে প্রবাহিত হয়।
জো এর সর্বশেষ বৈশিষ্ট্য হল নদীর জোয়ার-ভাটার জন্য অপেক্ষা করা। পূর্ণ জোয়ারের শেষে অথবা পূর্ণ ভাটার শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে। মা মাছেরা ডিম ছাড়ার আগে পরীক্ষামূলকভাবে অল্প ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ না পেলে মা মাছ ডিম নিজের দেহের মধ্যে নষ্ট করে দেয়। ডিম সংগ্রহ করে জেলেরা বিভিন্ন বাণিজ্যিক হ্যাচারিতে উচ্চমূল্যে বিক্রি করেন।
হালদা নদী এবং নদীর পানির কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য এখানে মাছ ডিম ছাড়তে আসে যা বাংলাদেশের অন্যান্য নদী থেকে ভিন্নতর। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ভৌতিক, রাসায়নিক ও জৈবিক। ভৌতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নদীর বাঁক, অনেকগুলো নিপাতিত পাহাড়ী ঝর্ণা বা ছড়া প্রতিটি পতিত ছড়ার উজানে এক বা একাধিক বিল, নদীর গভীরতা, কম তাপমাত্রা, তীব্র খরস্রোত এবং অতি ঘোলাত্ব। রাসায়নিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কম কন্ডাক্টিভিটি, সহনশীল দ্রবীভূত অক্সিজেন ইত্যাদি। জৈবিক কারণগুলো হচ্ছে বর্ষার সময় প্রথম বর্ষণের পর বিল থাকার কারণে এবং দুকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়ে নদীর পানিতে প্রচুর জৈব উপাদানের মিশ্রণের ফলে পর্যাপ্ত খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে যা প্রজনন পূর্ব গোনাডের পরিপক্কতায় সাহায্য করে।
অনেকগুলো পাহাড়ী ঝর্ণা বিধৌত পানিতে প্রচুর ম্যাক্রো ও মাইক্রো পুষ্টি উপাদান থাকার ফলে নদীতে পর্যাপ্ত খাদ্যাণুর সৃষ্টি হয়, এই সব বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে হালদা নদীতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছকে বর্ষাকালে ডিম ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করে যা বাংলাদেশের অন্যান্য নদী থেকে আলাদা। হালদা নদীর বাঁকগুলোকে “অক্সবো” বাঁক বলে। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল পানির প্রচণ্ড ঘূর্ণন যার ফলে গভীর স্থানের সৃষ্টি হয়। স্থানীয়ভাবে গভীর স্থানগুলোকে “কুম” বা “কুয়া” বলা হয়। উজান হতে আসা বিভিন্ন পুষ্টি ও অন্যান্য পদার্থ কুমের মধ্যে এসে জমা হয়। ফলে পানি অতি ঘোলা হয়। মা মাছেরা কুমের মধ্যে আশ্রয় নেয় এবং ডিম ছাড়ে।
এতোগুলো প্রাকৃতিক বৈশিষ্টে ঐশ্বর্যময় হালদা। পৃথিবীতে যার তুলনা মেলা ভার। কিন্তু হালদা নদী মানুষসৃষ্ট অসংখ্য কারণে বিপন্ন হচ্ছে দিনের পর দিন। প্রতি বছর কমছে মাতৃমাছ। একটি অসাধু শ্রেণী অবলীলায় হালদার মা মাছ ধরছে। এটিই তাদের কাছে বড় এক বাণিজ্য। অন্যদিকে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতায় কর্ণফুলি থেকে এই হালদামুখী হতে চায় না মা মাছ। কারণ পরিবেশটি তাদের অনুকূল নয়। হালদা যেন দিনে দিনে পরিণত হচ্ছে এক বন্ধ্যা নদীতে।
তৌকির আহমেদ এবার চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন সেই বিপন্ন হালদার জীবনকাব্য নিয়ে। অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। গল্পের দৈন্যে ঢাকার চলচ্চিত্র যখন দারিদ্রতায় পূর্ণ এক পঙ্গু শিল্পের পর্যায়ে পৌছে গেছে, তখন নদীর আত্মকথন আর জীবনালেখ্য আমাদেরকে নতুন করে দাঁড়ানোর জায়গা করে দিচ্ছে। হালদা নদীর পাড়ে নিছক কাল্পনিক প্রেক্ষাপটের চিত্রায়ণ নয়, বরং হালদার গভীরের মাটি এবার ছোঁয়া গেছে। হ্যা, হালদাকেই আমরা গল্পের নায়িকা ভাবতে চাই। তরুণী ভাবতে চাই, মা জননী ভাবতে চাই।
ঠিক এই দৃষ্টিকোণ থেকেই খুজে পাঁওয়া যায় চিত্রনাট্যকার ও পরিচালকের দূরদর্শিতা। ঠিকই মিলিয়ে দিয়েছেন নিঃসন্তান স্ত্রী, আর সন্তান দানে অক্ষম প্রভাবশালী পুরুষ আর তার প্রেমসিক্ত স্ত্রীর জীবনের ভেতর দিয়ে। ছোট স্ত্রী হালদাপাড়ের মৎস্যজীবীর মেয়ে। হালদার চারিত্র তাকে বড় করেছে। হালদার মা মাছ তার কাছে মাতৃসম। মা মাছের মৃত্যু হলে তার মধ্যে মাতৃশোক ঢুকে পড়ে। হালদার প্রতি সকল নির্ভরতা থেকেই হালদার তরুণ জেলের সঙ্গে ঘর বাঁধতে চায় সে। কিন্তু যখন টাকার জন্য মহাজনের মতো প্রভাবশালীর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে মেয়েকে সমর্পন করতে রাজি হয়ে যায় দরিদ্র মৎস্যজীবী বাবা; তখন প্রকৃতিতেও অন্ধকার নেমে আসে। তখন হালদার দুর্দিন। পূর্ণিমার জো আসলেও মাছের ডিম পায় না জেলেরা। বন্ধ্যাত্বের দিকে ধাবিত হয় নদীটি। আর বন্ধ্যাত্ব গ্রাস করে ওই প্রভাবশালীর পরিবারেও। নিজের শারিরীক অক্ষমতা জানে হালদাপাড়ের ওই সওদাগর। কিন্তু জানে না জীবনের জো কখন কোথায় আসে। জীবনের অমাবস্যা পূর্ণিমা ঠিক কোন চক্রে কোথায় মিলিত হয়। তাই দ্বিতীয় স্ত্রী সন্তান সম্ভবা হয়ে ওঠে জেলে প্রেমিকের যুথবদ্ধতায়।
প্রকৃত প্রাণের জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ। এই পরিবেশ সম্পদ আভিজাত্য আর আধিপত্য দিয়ে গড়া যায় না। এর জন্য চাই প্রয়োজনীয় অালো-আঁধারি, জীবনের নিখাদ সম্মিলন, প্রাণের গভীর উচ্ছ্বাস। বাংলাদেশের এ যুগের চলচ্চিত্রে এমন গভীরতা সন্ধানী কাজ, পর্যবেক্ষণ আর চিন্তার পরিস্ফুটন দেখা যায় না। প্রভাবশালী স্বামী তার স্ত্রীকে অবিশ্বাস করে, অত্যাচার নিপীড়ন করে, এগুলো হালদার ওপর প্রভাবশালীদের অত্যাচারেরই এক প্রতীকি রূপ হিসেবে দেখা যায়। আমরা চলচ্চিত্রের পরতে পরতে দেখি হালদার অত্যাচারিত দশাগুলো। এমন আনকোরা তথ্যচিত্র চলচ্চিত্রে প্রবেশ করানো কঠিন বটে।
কিন্তু গল্পের ভেতরে ভেতরে হালদার জীবনের মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়েছেন নির্মাতা। হালদার ঘোলা পানি, হালদা পাড়ের সকাল, সন্ধ্যা, রাত সবই অন্য এক ব্যঞ্জনায় ধরা দিয়েছে। যারা হালদার আখ্যান জানে না, তাদের কাছে অবশ্য এই চলচ্চিত্রের সার্থকতা খুব বেশি হবে না। একটি মা মাছের মৃত্যু কত বড় সাংঘাতিক ব্যাপার, এই বাস্তবতার কাছাকাছিও নেই সিংহভাগ মানুষ। তারা হয়তো খুঁজে পাবেন গতানুগতিক প্রেম, নায়ক নায়িকা আর ভিলেনের প্রচলিত কিছু। কিন্তু না; এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালেন করেছেন চলচ্চিত্রকার। সামাজিক দায়িত্ব। যেটি বৃহৎ গণমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রেরই কাজ।
আমরা হালদা সিনেমার শেষোক্ত ঘটনায় দেখি একদিকে প্রেমিক খুন হচ্ছেন হালদাপাড়ের নিপীড়ক ব্যবসায়ীর লোকজনদের হাতে অন্যদিকে নায়িকা নিজ হাতে হত্যা করছেন সেই ব্যবসায়ীকে। কিন্তু শেষে যে নারী বেঁচে রইলো, সেই আসলে হালদা, সে বড় একা এবং ক্লান্ত। নির্যাতনে নিপীড়নে সন্তান সম্ভবা নারীর জীবনে কিছুই অবশিষ্ট রইলো না।
মনে পড়ে যায় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রের কথা। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার এই চলচ্চিত্রের স্বপ্নই দেখতে পেতেন না যদিনা অদ্বৈত মল্লবর্মনের অনবদ্য ও একমাত্র উপন্যাসটি হাতে না পেতেন। উপন্যাসটিতে চলচ্চিত্রের সব উপাদানই একের পর এক মালা গাঁথার মতো করে সন্নিবেশিত। সেখানে চলচ্চিত্রকার ভেবেছেন ওই কাহিনীশিল্পটিরই যথার্থ চিত্রায়ণ ঘটানোর কথা। আদর্শ চলচ্চিত্র নির্মাণের শক্তি, নেশা, নিষ্ঠা আর শিল্পবোধ সবক্ষেত্রেই তিনি এক ধ্যানী সাধকের মতো। তাই তিতাস একটি নদীর নামকে তিনি ফুঁটিয়ে তুলেছেন একটি জনপদের গল্প হিসেবে।
কিন্তু হালদা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে শুধু নদীটি রয়েছে নির্যাতিত, নিপীড়িত বা উপেক্ষিত এক নারীর মতো। হালদা বাঙালির এক ঐশ্বর্যে পূর্ণ একটি সম্পদ। আমরা যে সময়ে নদীর জীবন নিয়ে কথা বলছি, নদীকে জীবিত মৃত বা তার চলৎশক্তি নিয়ে ভাবছি, সেই সময়ে হালদাই যেন তৌকির আহমেদের নেতৃত্বে একদল চলচ্চিত্র কর্মীকে দিয়ে মনের কথাটি প্রকাশ করিয়ে নিল।
সেখানে সত্যিই সার্থক হয়েছেন উদ্যোক্তারা। তারা বিশেষভাবে ধন্যবাদ পাবেন এই জন্য যে, এখানে শিল্পসৃষ্টির জন্য সত্যকে রংচং দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়নি বরং ধরা হয়েছে সত্যের রং। এটি অনেক বড় কাজ। এক্ষেত্রে সিনেমাটোগ্রাফার, সম্পাদকসহ সকল কারিগরী কর্মকুশলী এবং অবশ্যই অভিনেতা অভিনেত্রীরা তাদের সর্বোচ্চ মনোযোগ ও আন্তরিকতার নজির রেখেছেন বলে মনে হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)