উৎসব ভাব ছিল প্রাঙ্গণ জুড়ে। পুরো ভবন জুড়ে। প্রথমত নিজের ভবন। এখানে ওখানে সুন্দর করে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সিনেমার পোস্টার। ‘দর্পচূর্ণ’, ‘এতটুকু আশা’ কিংবা ‘মুখ ও মুখোশ’। আরও সব প্রায় বিস্মৃত হয়ে যাওয়া সিনেমার পোস্টার বয়ান। সিঁড়ি ভাঙ্গলেও দেওয়ালে সাঁটানো পোস্টার আর সিঁড়ির রেলিংয়ে বেলুন। উদ্বাস্তু জীবনের অবসান। ৪০ বছর পূর্তি। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের আগারগাঁও নিজ ভবন ও প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী ছিল নানা অনুষ্ঠানে মুখর।
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের এমন উৎসব মুখর আয়োজনে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘যাদের ইতিহাস নেই, তারা ইতিহাস ধ্বংস করে’। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এবং উৎসব উদ্বোধক হিসেবে তিনি আরো বলেন, শেখ হাসিনা ইতিহাসের পক্ষে তাই আর্কাইভ গড়েছেন। কারণ আর্কাইভ সঠিক ইতিহাস রক্ষা করে।’ ‘সংস্কৃতিচর্চায় জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পরম যত্নবান’ উল্লেখ করে ইনু বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই আজ দেশের ফিল্ম আর্কাইভটি এখন বিশ্বমানের। আর ২০২১ সালের বিশ্ব ফিল্ম আর্কাইভ কংগ্রেস ঢাকায় আয়োজনের সম্মান দেশের একটি বড় অর্জন।
বৃহস্পতিবার ছিল প্রতিষ্ঠার চার দশক পূর্তি। প্রতিবছর এই দিনটিকে প্রতিষ্ঠানটি উদযাপন করে আসছে ‘জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভ দিবস’ হিসেবে। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও দেশের চলচ্চিত্রের তথ্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটি আয়োজন করে দিনব্যাপী নানা আয়োজন। যে আয়োজনে গতকাল সকাল থেকে ছিল-ধ্রুপদী চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং বিকেলে ছিল আলোচনা সহ নানা আয়োজন। এ সব আয়োজনের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তার এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করলো।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠানটির নবনির্মিত ভবনের অডিটরিয়ামে এ উপলক্ষে গতকাল বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় উদ্বোধনী আয়োজন। আয়োজনে ভবন চত্বরে পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে প্রতিষ্ঠানটির এ ৪০ বছরপূর্তি আয়োজন উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানমালার প্রধান অতিথি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এসময় এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্যসচিব আবদুল মালেক এবং চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক শচীন্দ্র নাথ হালদার। এছাড়াও এসময় উপস্থিত ছিলেন অভিনেত্রী রোজিনা, চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম, গবেষক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, চিত্রনায়িকা অঞ্জনা, দিলারা প্রমূখ।
আয়োজনের উদ্বোধন করে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘সরকারে যেমন আর কখনো রাজাকার-সন্ত্রাসীদের স্থান দেয়া যাবেনা, সরকারি দপ্তরগুলোতেও তেমনি জঙ্গি-রাজাকার-অনুচরদের স্থান হবেনা।
দেশের চলচ্চিত্র জগতের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করে তথ্যমন্ত্রী জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পথে একদিকে যেমন জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম চালিয়েছেন, আরেকদিকে গড়েছেন শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। অপূর্ব দূরদৃষ্টিতে তিনি ঢাকায় এফডিসি প্রতিষ্ঠা করে বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের দিগন্ত উন্মোচন করেন।’
তথ্যসচিব আবদুল মালেক বলেন, ‘ফিল্ম আর্কাইভ ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংযোগ এবং সরকার দেশের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’
এরপর দিনব্যাপী এ আয়োজনের অংশ হিসেবে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ: ৪০ বছরের অগ্রযাত্রা’ শীর্ষক সেমিনার। যেখানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক, গবেষক ও শিক্ষক অনুপম হায়াৎ। প্রবন্ধে আর্কাইভের বর্তমান অবস্থাসহ বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। আলোচক ছিলেন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ খ্যাত নির্মাতা আমজাদ হোসেন, ‘চাকা’ নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম ও ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন।
নির্মাতা আমজাদ হোসেন বলেন, রাজনৈতিক চেতনা, শ্রেণীসংগ্রাম, ইতিহাস-সঙ্গীতের ওপর ভালো দখল না থাকলে ভালো ছবি হবেনা। চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থায় নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। ইউরোপেও আজকে সিনেমার খরা চলছে। আমরা তো এখন অস্তগামী সূর্য। তারুণ্যের হাত ধরে সুদিন ফিরবেই। পরিচালক ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ ঠিকই তবে ব্যক্তিগত প্রতিভা না থাকলে ভালো সিনেমা হয়না।’ তিনি আরো বলেন, জীবিত অবস্থায় আর্কাইভের নিজস্ব ভবন দেখে গেলাম এটি স্বান্তনা।’
নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম আর্কাইভের পুরো কতিত্ব বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ফসল হিসেবে উল্লেখ করেন। মূলধারার নির্মাতারা আর্কাইভ সম্পর্কে সচেতন ছিলেননা বলে জানান তিনি।
এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় ধ্রুপদী চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে শুরু হয় ফিল্ম আর্কাইভ দিবস উদ্যাপনের দিনব্যাপী এই আয়োজন। প্রতিষ্ঠার চার দশক পূর্তিতে ধ্রুপদী চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর এ আয়োজনে প্রদর্শিত হয় প্রমথেশ বড়ুয়ার পরিচালনায় ১৯৩৫ সালে নির্মিত সর্বভারতীয় চলচ্চিত্র ‘দেবদাস’ ও ১৯৬২ সালে নির্মিত রবার্ট এনরিকো পরিচালিত ফরাসি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ইনসিডেন্ট এট আউল ক্রিক’। তবে জহির রায়হানের অসমাপ্ত চলচ্চিত্র ‘লেট দিয়ার বি লাইট’ এর নির্বাচিত ফুটেজ প্রদর্শন করার কথা থাকলেও জহির রায়হান পরিবারের আপত্তিতে তা প্রদর্শিত হয়নি। পরিবারের অভিযোগ তাদের অনুমতি ছাড়া সম্পাদনা করা হয়েছিল ফুটেজে।
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের পরিচালক ইয়াকুব আলী জানান, চলচ্চিত্রের জন্য প্রতিষ্ঠানটি বিরাট তথ্যভান্ডার। প্রতিষ্ঠার চার দশক পূর্তির পাশাপাশি মুভিপ্রেমীদের মধ্যে এ তথ্যটা পৌঁছে দিতেই এবারের এ আয়োজন। তিনি আরো বলেন, এর বাইরে নিয়মিত এখানে প্রতি সপ্তাহে একটা করে পুরনো চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার প্রদর্শনী সিনেমাপ্রেমীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।