চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

চরমপন্থায় কেন এত প্রবাসী

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারের এখন পর্যন্ত পাওয়া চিত্রে উল্লেখযোগ্য একটি অংশের বিদেশ সংশ্লিষ্টতা আছে। এর নানাদিক বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গিবাদ যে বৈশ্বিক রূপ ধারণ করেছে, তা থেকে কেউই আর হুমকিমুক্ত নয়। জঙ্গিবাদের মূল ‘খেলোয়াড়রা’ এমন ব্যক্তিদের টার্গেট করছে যাদের জন্ম বা বেড়ে উঠা বাংলাদেশের মতো দেশে হলেও পশ্চিমা দেশের পাসপোর্ট থাকায় সহজেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করতে পারে।

আবার, বিদেশে পড়তে যাওয়া তরুণদের টার্গেট করে তারা তাদের সৈনিক হিসেবে ওই তরুণদের জঙ্গিবাদ বিস্তারে জন্মভূমিতে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গুলশান-শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা এবং সর্বশেষ কল্যাণপুরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মাঝে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা প্রকট হয়ে উঠেছে। জঙ্গিদের সামাজিক অবস্থানের ভিন্নতা, বিদেশী সংযোগ, নিখোঁজ তালিকায় থাকা সম্ভাব্য জঙ্গিদের বিদেশী নাগরিকত্বের বিষয়গুলো তাই গভীরভাবে ভাবতে বলছেন তারা।

তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জঙ্গিদের অবস্থান বা নাগরিকত্বের সূত্রে ৭টি দেশের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও জাপানের মতো এশীয় দেশ যেমন আছে তেমনি আছে অস্ট্রেলিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশ।

এই জঙ্গিদের অনেকেরই নেতৃস্থানীয় অবস্থান গণমাধ্যম সূত্রে জানার পর খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেকে প্রশ্ন করছেন: বড় জঙ্গি হওয়ার পেছনে কি বিদেশ সংশ্লিষ্টতার একটা সম্পর্ক রয়েছে?

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বিদেশীদের প্রভাব বিস্তারী ভূমিকা লাভের পেছনে বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণের সহজাত প্রক্রিয়া ছাড়াও তাদের প্রাপ্ত বিভিন্ন সুবিধার কথা উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য, কানাডা বা জাপানের পাসপোর্ট থাকলে যেকোন দেশে যাতায়াতে ভিসা পেতে সুবিধা হয়, বাংলাদেশের নাগরিকের পক্ষে যা সম্ভব নয়। আবার আর্থিকভাবেও তারা স্বচ্ছল থাকে। ফলে জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল ইরাক বা সিরিয়ার মতো দেশগুলোতে তাদের ভ্রমণও সহজ হয়ে যায়।

কানাডার নাগরিকত্ব থাকা তামিম চৌধুরী গুলশান, শোলাকিয়ায় হামলার পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, সার্বিক অর্থায়ন– সবকিছুর সঙ্গেই জড়িত বলে জানিয়েছেন আইজিপি শহীদুল হক। কল্যাণপুরে পুলিশি অভিযানে নিহত জঙ্গিদেরও তামিম সহায়তা দিতেন বলে আইজিপি জানান।

আবার সাম্প্রতিক সময়ে দুই দফায় সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানো ৩২ জনের মধ্যে ২৩ জনের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায় পুলিশ। আর জঙ্গি হামলাকারীদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ লেখাপড়া করতো বা করেছে মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালয়েশিয়ার ক্যাম্পাসে।

দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে এদের মতো প্রবাসীদেরকে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠি সহজেই ‘মগজ ধোলাই’ করতে পারে বলে মনে করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত।

তবে, প্রবাস জীবনে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হলেও সহিংসতা তারা বাংলাদেশেই চালাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন সাখাওয়াত হোসেন।

এসব প্রবাসীর জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া এবং নেতৃস্থানীয় অবস্থানে চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপট তাদের আলাদাভাবে বিশ্লেষণ না করে বলা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল।

তবে বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিরাপত্তাহীনতা, বিদ্রোহী চেতনার নেতিবাচক ব্যবহার, প্যাসিভ ব্যক্তিত্বসহ জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্ট হয়ে যাওয়ার বেশ কিছু মনস্তাত্তিক কারণ তুলে ধরেন তিনি।

মোহিত কামাল বলেন, যেসব সন্তান বাবা-মা থেকে দূরে থাকে তাদের মধ্যে নিরাপত্তা বোধের অভাব, বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হয়, কারো কারো অপরাধ বোধ থাকে। বাবা-মার ডিভোর্স বা বিচ্ছেদও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আবার মাদকের কারণেও এমনটি হয়। ফলে তারা সহজেই প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। এদেরকে বলা হয় প্যাসিভ ব্যক্তিত্বের।

আরও একটি প্রেক্ষিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, টিন-এজাররা অনিয়ম-অবিচার সহ্য করে না। অনিয়মের শিকার হলে তারা সহিংস হয়। আবার শিশুরা কম্পিউটারে বিভিন্ন সহিংস গেমস খেলছে। এর ফলে তাদের মধ্যে সহিংসতার বীজ রোপিত হচ্ছে।

গুলশানে হামলাকারী নিবরাস ইসলাম অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসে পড়াশোন করতো। তার বন্ধু মার্কিন পাসপোর্টধারী শেহজাদ রউফ অর্ক কল্যানপুরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়। গুলশানে হামলার সাথে জড়িত সন্দেহভাজন হাসনাত করিমের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব রয়েছে।

প্রকাশিত নিখোঁজ তালিকায় থাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি জাপান প্রবাসী ধর্মান্তরিত মুসলিম। আরেকজন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লক্ষীপুরের এটিএম তাজউদ্দিন কাউসার। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরীকে তাদের বাংলাদেশ প্রধান বলে দাবি করে কথিত অাইএস।

হালনাগাদ নিখোঁজ তালিকায় আরও রয়েছে ফেনীর মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে রাশেদ হোসেন (বর্তমানে ভারতের মুম্বাই) এবং বরিশালের মেহেদীগঞ্জের রহিম শাহের ছেলে জুবায়ের হোসেন ফারুক (বর্তমানে মালয়েশিয়া)।