চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ঘরে বাইরে নারীর শত পরীক্ষা

সকালে ঢাকার ব্যস্ত সড়ক। যানজট-ধুলা আর মানবজটে বিশৃংখল রাস্তায় স্কুটি চালিয়ে স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছেন মা। বাচ্চাকে স্কুলে নামিয়ে মা ছুটবেন কর্মক্ষেত্রে। ইদানিং ঢাকার রাস্তায় মেয়েদের স্কুটি চালাতে দেখা যায় প্রায়ই। নানা ক্ষেত্রে মেয়েদের সাফল্যের খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সাফল্য এদেশি মেয়েদের। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনেও যাচ্ছে আমাদের মেয়েরা। সবশেষ, সাফ গেমসে বাংলাদেশের জন্য স্বর্ণ এনেছেন দুই কন্যা। এসবই মেয়েদের এগিয়ে চলার চিত্র। 

বিপরীত চিত্রও আছে। এইতো সেদিন হাজারো খবরের ভিড়ে চোখ আটকে গেলো একটিতে। পর পর দুই মেয়ের জন্ম হওয়ায় সাতক্ষীরায় স্ত্রীকে তালাক। কেবল তাই নয়, যৌতুকের কারণে নির্যাতনের কথা যেনো প্রকাশ না করে সেজন্য অপহরণ ও হত্যার হুমকিও দিয়ে আসছে সাবেক স্বামী। তাতেও ক্ষান্ত হয়নি, ওই নারীকে তার বাবার বাড়ি গিয়ে ধর্ষণের চেষ্টাও করেছে। কেনো মেয়ের জন্ম হলো তাই এতো ক্ষোভ-ক্রোধ! একুশ শতকে যখন নারীর সাফল্য সবখানে, পৃথিবী নামের গ্রহের বাইরে মহাশূন্যেও নারীর যাত্রা তখনও মেয়ের জন্ম মানতে কষ্ট!

এই কষ্ট কেবল বাংলাদেশে নয়। পাশের দেশ ভারতের চিত্রতো আরও ভয়াবহ। সেখানে আইন কিংবা মানবাধিকারকর্মীদের উদ্বেগ-পদক্ষেপ উপেক্ষা করে বেড়েই চলেছে মেয়ে ভ্রুণ আর মেয়ে শিশু হত্যা। মানবসভ্যতার ১২ হাজার বছর পেরোলেও কোনো কোনো সমাজ নারীকেই মানতে পারছে না!

নারী-পুরুষের সমতার দাবিতে এবারের নারী দিবসের শ্লোগান ‘প্লেজ ফর প্যারিটি’। আর জাতিসংঘের থিম ‘প্ল্যানেট ফিফটি-ফিফটি বাই টু থাউজেন্ড থার্টি, স্টেপ ইট আপ ফর জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি’। তবে দু’বছর আগে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের পূর্বাভাস ছিলো, নারী পুরুষের সমতা আসতে অপেক্ষা করতে হবে ২০৯৫ সাল পর্যন্ত। আর গতবছর সেই পূর্বাভাস গেলো বদলে। বলা হচ্ছে, নারী-পুরুষ বৈষম্য সম্পূর্ণ নির্মূল হবে একুশশো’ ৩৩ সাল নাগাদ।

আসলে শুধু সংখ্যা আর ইনডেক্স দিয়ে কি নারী-পুরুষ সমতা নির্ণয় সম্ভব? এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের অন্যতম একটি হলো লৈঙ্গিক সমতা অর্জন। এক্ষেত্রে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতায়ন এই দু’টো সূচকের কথা আসে সবার আগে। আর দ্বন্দ্বটা এখানেই। কখনও কখনও দেখা যায় বাহ্যিকভাবে ক্ষমতায়ন যদি বা হয় মানবাধিকার আর অর্জন হয় না। যেমন, একটি মেয়ে শীর্ষস্থানীয় কোনো বিদ্যাপীঠ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ভালো চাকরিও পেলো। যোগ্যতার স্বীকৃতিতে পদোন্নতিও হচ্ছে। বাহ্যিকভাবে ক্ষমতায়নের লক্ষ্য অর্জনের পথে মেয়েটি। আর্থিকভাবে সে তো স্বাবলম্বী। আর কর্মক্ষেত্রে পদাধিকার বলে ক্ষমতা আছে।

কিন্তু মানবাধিকার? প্রতিনিয়ত হাজারো মানসিক ক্ষুদ্রতার মুখোমুখি সে। পরিবারে তো সে বউ, মা কিংবা মেয়ে। তার শুনতে হচ্ছে সেই পুরনো কথা, যতোই পড়াশোনা করো আর ভালো চাকরি করো, সংসারের দায়িত্ব সবার আগে। স্বামীর কথা, আমার আর্থিক সচ্ছলতা আছে, তারপরও যখন চাকরি করছো, সব ভালোমতো সামাল দেওয়ার পর করবে। আর তাই অনেক বেশি সচেতনতা, অনেক বেশি চাপ নিয়েই চলতে হয়। কখনও কখনও এই টানাপোড়েনের একপর্যায়ে সংসার টিকাতে চাকরিই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় কেউ কেউ।     

অনেক ক্ষেত্রে আবার উল্টোটাও হতে পারে। পরিবারের উৎসাহ আর শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগসহ সব ধরনের অধিকার নিয়ে বড় হওয়ার পর কর্মক্ষেত্রে শিকার হচ্ছে বৈষম্যের। এন্ট্রি লেভেলে আমাদের কর্মসংস্থানক্ষেত্র এখন অনেক উদার। তবে মধ্যম কিংবা উচ্চ পর্যায়ে নিয়োগ বা পদোন্নতির প্রশ্নে বিপত্তি। বার বারই যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েও পরীক্ষায় সহজে পাস হয় না।

অনেক অফিস তো সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে থাকে কোনো কোনো বিভাগে নারীদের না নেওয়ার। আবার অনেক ক্ষেত্রে নারীকে তার গতিতে এগোতেও দেয়া হয় না। প্রোমোট করার নামে অযথা বাড়তি মনোযোগ নষ্ট করে দেয় আত্মবিশ্বাসকেই। তাছাড়া বার বার দক্ষতার প্রমাণ দিলেও অনেক ক্ষেত্রে কেবল মেয়ে বলেই আটকে যায় তার উপরে ওঠার সিঁড়ি। নিরন্তর পরীক্ষার যেনো শেষ নেই।

অসহিষ্ণুতার হাজারো উদাহরণ যেমন আছে, তেমনি আছে সহযোগিতার চমৎকার নজির। পরিবারে নারীর মতামত উপেক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি এমনও আছে পরিবারের ছোটবড় প্রায় সব বিষয়েই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন নারী। তৃণমূলেও হচ্ছে পরিবর্তন। আর্থিক সচ্ছলতা আনতে স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীও আয় করছেন। রাস্তার পাশে ছোট্ট চুলা আর হাঁড়ি নিয়ে বসছেন পিঠা বিক্রিতে। হয়তো ওই সময়টায় ঘর সামলাচ্ছেন স্বামী। রাস্তার পাশে কিংবা গলিতে নারী চা দোকানীর দিকে ক’বছর আগেও মানুষজন বাঁকা চোখে তাকালেও এখন বদলেছে দৃষ্টিভঙ্গি। গভীর রাতে প্রত্যন্ত এলাকায় মুমূর্ষু রোগীর প্রয়োজনে তার কাছে নারী চিকিৎসককে হয়তো নিয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ শ্বশুর। 

নারী-পুরুষ সমতার জন্য আসলে সবার আগে প্রয়োজন মানবিকতা। সেটা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি সবখানেই। সহনশীলতা আর পারস্পরিক সহযোগিতায় অনেক বাধাই দূর করা যায় সহজেই। নারী-পুরুষ সমতার পরিমাপক কেবল আর্থসামাজিক সূচক বা সংখ্যা দিয়ে নয়, সবার আগে প্রয়োজন গুণগত পরিবর্তন আর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)