ক্যাথরিন বিগেলো। একজন চলচ্চিত্র-নির্মাতা, প্রযোজক এবং লেখক। নিজেকে অন্য যেকোনো নির্মাতার মতোই ধারালো ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। আশির শেষ ও নব্বইয়ের শুরুর দিকে ক্যাথরিন বিগেলো কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন মূল ধারার হলিউড ফিল্মকে। ‘নিয়ার ডার্ক’ এবং ‘পয়েন্ট ব্রেক’ শিরোনামের চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে। তাঁর চলচ্চিত্র ‘দ্য হার্ট লকার’ বিশ্ব-চলচ্চিত্রের আসরে ইরাক যুদ্ধের উপর নির্মিত সেরা চলচ্চিত্রগুলোর একটি হিসেবেই বিবেচ্য। আর এই ছবির জন্যই অস্কার অ্যাওয়ার্ডের নব্বই বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র অস্কারজয়ী কোনো চলচ্চিত্র নির্মাতা, যিনি নারী। ২০১০ সালে ‘সেরা চলচ্চিত্র’ এবং ‘সেরা নির্মাতা’ হিসেবে জেমস ক্যামেরন ও কোয়ান্টিন টারান্টিনোর মতো নির্মাতাদের টেক্কা দেন। কারণ সে বছরেই অস্কারে ক্যাথরিন বিগেলোর ‘দ্য হার্ট লকার’কে যুদ্ধ করতে হয়েছে ক্যামেরুনের ‘অ্যাবাটার’ এবং টারান্টিনোর ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ড’-এর মতো দাপুটে সিনেমাগুলোর সাথে।
রাত পোহালেই পর্দা উঠবে নব্বইতম অস্কার অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের। অস্কার নিয়ে মানুষের জল্পনা কল্পনারও অবসান হবে ভোরেই। নব্বইতম অস্কারে কারা কারা পুরস্কৃত হচ্ছেন, তা নিয়ে মেতে উঠবেন সবাই। তার আগে অস্কারের ইতিহাসে নির্মাতা হিসেবে একমাত্র পুরস্কার জয়ী নারী-র একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হলো। যা ‘দ্য হার্ট লকার’ অস্কার জয়ের পর পরেই প্রকাশ পায় লন্ডনভিত্তিক ‘টাইম আউট’ নামের একটি কাগজে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডেভিড জেনকিনস। ইংরেজিতে নেয়া সাক্ষাৎকারটি চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করেছেন জুয়েইরিযাহ মউ। সাক্ষাৎকারে নির্মাতা ক্যাথরিন বিগেলো কথা বলেছেন ‘দ্য হার্ট লকার’ চলচ্চিত্র নির্মাণের পেছনের ঘটনা নিয়ে এবং এ চলচ্চিত্রের নির্মাণ-ভাবনা নিয়ে:
‘দ্য হার্ট লকার’ যুক্তরাজ্যে ব্যাপক আলোচিত হয়, অনেক রিভিউ বের হয়। আপনি কি উপভোগ করেছিলেন এ রিভিউগুলো ?
উম, হুম। আমি পড়ছিলাম এবং মুখস্থ রাখার চেষ্টা করেছিলাম। হা হা হা হা। মজা করছি। আসলে এটা তো একধরণের সন্তুষ্টি এনে দেয়, এছাড়া উৎসাহোদ্দীপকও একটি ফিল্মের জন্য।
চলচ্চিত্রটি বাগদাদে ইরাক যুদ্ধের সময়ের প্রেক্ষাপটে নির্মিত। আপনি কি এ ধরণের চলচ্চিত্রগুলোও পছন্দ করেন যেগুলোতে যুদ্ধের কাল্পনিক উপাদানও বিদ্যমান, যেমন- ‘লায়নস ফর ল্যাম্বস’, ‘ইন দ্য ভ্যালি অব এলাহ’ এবং ‘ব্যাটল ফর হাদিথা’?
সত্যি বলতে কি, আমি এই ভাবনার মধ্যে অনেককাল ডুবে ছিলাম। আমরা শুরু করেছিলাম সেই ২০০৫ সালের দিকে। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিলাম শুরুতেই যে, অন্যান্য নির্মাতারা যুদ্ধকে যেভাবে দেখছেন বা দেখাচ্ছেন আমি সেভাবে যুদ্ধকে দেখাবো না। ‘দ্য হার্ট লকার’- এ আমি চেষ্টা করেছি সংবাদমাধ্যম থেকে খবরাখবর সংগ্রহ করে একটি বাস্তবসম্মত, যথার্থ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে। শ্রেণীগত সামরিক উপাদান কম ব্যবহার করতে চেয়েছি এক্ষেত্রে।
এ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার মার্ক বোয়াল-এর সাথে প্রথম কখন কথা হয় আপনার?
আমি সাংবাদিকতা পছন্দ করি এবং মার্ক-এর বেশ কয়েকটি লেখা আমার দারুণ পছন্দ হয়েছিল। আমাদের দেখা হয়েছিল বাগদাদে এক্সপ্লোসিভ অর্ডন্যান্স ডিসপোজাল(ইওডি) ইউনিটের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে যাওয়ার পূর্বেই। তিনি ফিরে আসার পরে আমরা উনার অভিজ্ঞতা, সামনে থেকে দেখা চরিত্রগুলো নিয়ে কথা বলেছিলাম। এবং আমাদের মনে হয়েছিল চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য এটা দারুণ একটা বিষয় হতে পারে।
‘ইওডি’কে যদি এরকম মনে হয় যে চিত্তাকর্ষক, নতুন, একেবারে মাটি খুঁড়ে বের করা একেকটা চরিত্র সে সম্পর্কে কি বলবেন?
উনারা আসলে সার্জন, যখন ‘ইওডি’তে আপনাকে নেওয়া হবে তখন দেখা হয় আপনার চাতুর্য, বুদ্ধিদীপ্ততা এবং প্রকৌশলী হিসেবে আপনার দক্ষতা কেমন। একটা তারের ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই একটা ফোন কল করার যোগ্যতা আপনার থাকতে হবে। এরচে বেশি সময় নিলেই শত্রুর গুলি এসে বিঁধবে আপনার শরীরে। যদিও একজন সার্জন থেকে এ ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ ভিন্ন, এক্ষেত্রে যদি তারা দেরি করে তবে রোগী মারা যাবে, কিন্তু যদি আপনি দেরী করেন আপনি নিজেই মারা যাবেন।
এই চলচ্চিত্রটি বেশ ভারসাম্য বজায় রেখেছে চরিত্র এবং ঘটনার ক্ষেত্রে।
একদিকে আমার মনে হয় ‘ইওডি’ সবচে বিপজ্জনক কাজটিই করছে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে এটিই স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা পরিচালিত মিলিটারী সংগঠন। তাই আপনাকে খুবই আকর্ষণীয় মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ব্যাপারটি ডিল করতে হতে পারে। এইরকম কিছু বিষয়, কি হতে পারে সেগুলো যার প্রতি আপনি বা আমি আকৃষ্ট হতে পারি, ছুটে যেতে পারি?
জেরেমি রেন্যার-এর সার্জেন্ট জেমস হল প্রধান চরিত্র এ চলচ্চিত্রের। এই চরিত্রের জন্য আপনি বিশেষভাবে কী কী খুঁজছিলেন?
প্রথমত, এবং অবশ্যই আমি একজন দক্ষ অভিনেতা খুঁজছিলাম, যা বেশিরভাগ চলচ্চিত্র নির্মাতাই করে থাকেন। আমি প্রথম তাঁকে দেখেছিলাম ‘দাহমের’ ছবিতে। যদিও সেই চলচ্চিত্রে ভিন্ন ধরণের চরিত্রে তিনি ছিলেন তবু অভিনয়ের যে দক্ষতা এবং সততা সেটা ছিল তাঁর মধ্যে। তিনি তখন ‘টুয়েন্টি এইট উইকস লেটার’ ফিল্মের শুটিং এ লন্ডনে ছিলেন, আমি তার সাথে ফোনে কথা বললাম, তাকে স্ক্রিপ্ট পাঠালাম। এবং আমি জানতাম যে আমি সার্জেন্ট জেমসের সাথেই কথা বলছি, আমি উনাকেই নির্বাচন করলাম এই চরিত্রের জন্য। যদিও তখন পর্যন্ত আমরা দেখাও করিনি।
সার্জেন্ট জেমস কি বাস্তব চরিত্রের উপর ভিত্তি করে তৈরি চরিত্র?
দিনশেষে এটা তো ফিকশন,কিন্তু আমি জানি মার্ক আসলে সেইসমস্ত মানুষের কথাই লিখেছেন যাদের সাথে তিনি সময় কাটিয়েছেন, তো রেন্যার এর চরিত্রে তার ছাপ নিশ্চয় কিছুটা আছে।
ইরানিয়ান সাধারণ জনগণের কাছ থেকে একটা দূরত্ব রাখা হয়েছিল এই চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, সেটা কেন করেছিলেন?
এটা এমন একটা চলচ্চিত্র যা আসলে ইউএস সেনাবাহিনীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ঘটনাকে ঘিরে নির্মিত। মার্ক সৈন্যদের সাথে ছিলেন এবং তার বক্তব্যের উপস্থাপন আসলে সামগ্রিক ঘটনা বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিছক একজন সৈন্যের সৎ বক্তব্যেরই উপস্থাপন। যদিও আমি নিশ্চিত এখন বিষয়টা ভিন্ন। কিন্তু সেই সময়টায়, যখন তিনি বের হয়ে এসেছিলেন, সবচে হতাশার বিষয় ছিল পারস্পরিক যোগাযোগোহীনতা। ভাষাগত সমস্যা ছিল, পর্যাপ্ত দোভাষীও পাওয়া যায়নি তখন।
যদিও এটা আমার অনুমান তবু এটা যুক্ত হতে পারতো হয়তো, এই যে বিচ্ছিন্নতা, বিভ্রান্তি আর সত্যিকার অর্থেই সমূহ নিরাপত্তাহীনতার মূখোমুখি হওয়া। শুধুমাত্র একটা যথার্থ পথ খুঁজে না পাওয়া যে কী করে এসব প্রকাশ করা যেতে পারে। আমার মনে হয় এই দ্বন্দ্ব আরও অবাস্তব হয়ে উঠছিলো কারণ আমরা যুদ্ধ নিয়ে ভাবি যুদ্ধের পেছনে কিংবা সামনে থেকে, অথবা হয়তো মাঠে বা যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করতে করতেও। কিন্তু ঘন বসতিপূর্ণ নাগরিক জীবনে বসে যুদ্ধ নিয়ে আমরা ভাবি না।
এটা একটা আইডিয়া যে কোন জায়গাই নিরাপদ নয়, ‘দেয়ার ইজ নো সেভ জোন।’ প্রতিটা জায়গাই পরিবর্তনশীল এসমস্ত সময়ে।