গ্রুপ ‘ডি’। ডি’তে ডেথ বলা যেতে পারে! তবে কেবল বলার জন্য বলা নয়, রাশিয়া বিশ্বকাপে মেসিদের প্রথম ধাপের লড়াই আবর্তকে সত্যিকারের ডেথ গ্রুপই বলছেন বিশ্লেষকরা। যেখানে আর্জেন্টিনাকে ‘সম্ভাব্য’ গ্রুপ সেরার তালিকায় রেখে চোখ দিতে হচ্ছে আইসল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, নাইজেরিয়ার দিকেও। নিজেদের দিনে যারা সেরাটা দিয়ে বিপদে ফেলে দিতে পারে যেকোনো প্রতিপক্ষকেই।
দেখে নেয়া যাক গ্রুপ ‘ডি’তে কে কেমন অবস্থায় থেকে রাশিয়ার মঞ্চে নামতে যাচ্ছে-
আর্জেন্টিনা
পূর্বে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ: ১৫ বার
সেরা সাফল্য: ১৯৭৮, ১৯৮৬ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। ১৯৩০, ১৯৯০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপে রানার্সআপ
ফিফা র্যাঙ্কিং: ৫
আর্জেন্টিনা গ্রুপ ‘ডি’তে অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেজন্য মেলাতে হবে কিছু প্রশ্নের উত্তর। দলে লিওনেল মেসির অবস্থান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু হাভিয়ের মাশ্চেরানো, অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া ও গঞ্জালো হিগুয়েনরা যতটা সপ্রতিভ হওয়ার কথাটা ঠিক সেভাবে জ্বলে উঠতে পারছেন না। আক্রমণে মেসির সঙ্গে ম্যানসিটি তারকা সার্জিও আগুয়েরোর বোঝাপড়া বাড়াতে হবে আরও।
আলবিসেলেস্তেদের খেয়াল রাখতে হবে পাওলো দিবালার দিকেও। সিরি আতে জুভেন্টাসের হয়ে ২২ গোল করা ফরোয়ার্ড আছেন দারুণ ফর্মে। তাকে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে। নিকোলাস ওটামেন্ডিকে রক্ষণে আরও জ্বলে উঠতে হবে। স্পেনের বিপক্ষে ৬-১ গোলে হারা ম্যাচে তার বেশ কিছু ভুল ছিল অমার্জনীয়।
মাঝমাঠে বেশ নড়বড়ে অবস্থা চলছে আর্জেন্টিনার। ম্যানুয়েল লানজিনি ছিটকে গেছেন চোটে পড়ে। এভার বানেগার অবস্থা বিশেষ সুবিধার নয়। তাই কোচ সাম্পাওলিকে কঠিন মনোযোগ দিতে হবে মাঝমাঠের কৌশলে।
দিনশেষে মেসিকে ঘিরেই গল্প লিখবে আর্জেন্টাইনরা। সে গল্প যেন বেদনার না হয় সেজন্য নিজেদের সামর্থ্যে সেরাটা দিয়েই খেলতে হবে দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের। প্রত্যাশা এবার আকাশ চুম্বী না হলেও যে চাপ আছে সেটাই কাত করে দিতে পারে। সেই চাপ জয়েরও পথ খুঁজে বের করতে হবে সাম্পাওলিকে।
কোথায় শক্তি?
লিওনেল মেসিতো আছেনই। এর বাইরেও এবারের আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় শক্তি অভিজ্ঞ-তরুণের মিশেলে ঝলকের সুযোগ থাকা। পাভন-সোলসোদের সামর্থ্য মেসিকে সাহায্য করলে দারুণ কিছু সম্ভব। বাছাইপর্বে টানাটানির পর এবারের আর্জেন্টিনাকে ঘিরে প্রত্যাশা কিছুটা কম! চাপ না থাকাটা ইতিবাচক নির্ভার পারফর্ম করার সুযোগ দেয়। খোদ লিওনেল মেসিও বলছেন সেমি পর্যন্ত যেতে পারলেই মিশন সাকসেসফুল! ধুঁকে ধুঁকে বাছাইপর্ব পেরোনোয় আর্জেন্টাইনরাও তাই খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা করছেন না।
এবারের বিশ্বকাপ হতে পারে লিওনেল মেসির শেষ বিশ্বকাপ! তাই পাঁচবারের বিশ্বসেরা ফরোয়ার্ডের জন্য এবারের মিশন হতে চলেছে ‘হয় এবার নয় কখনোই না’। মেসির সেরাটা বেরিয়ে আসার তাড়না যোগাতে পারে এই শেষ চাওয়া। যা উদ্দীপ্ত করতে পারে পুরো দলকেই।
কোথায় দূর্বলতা?
মেসিই সাফল্য, আবার মেসিই দুর্বলতা! লিওনেল মেসির ওপর নির্ভরতাই আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা। বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে অধিনায়ককে ছাড়া কতটা অসহায় সতীর্থরা। মেসি একবার খেই হারালে খেলা যেন ভুলে যান বাকীরা!
চোটজর্জর মাঝমাঠ আর রক্ষণ যেন আলবিসেলেস্তেদের বেহুলার বাসর! আক্রমণে নামি-দামি তারকা থাকার পরও জাতীয় দলের হয়ে তারা থেকে যান ম্লান। কেনো? বিশ্বকাপে নামার সময় এসব প্রশ্নের উত্তর সাম্পাওলির জানা না থাকলে বিপদ ঘটতে পারে। উত্তর যতটা দ্রুত মিলবে, টুর্নামেন্টে ততদূরই যাবে আর্জেন্টিনা।
ক্রোয়েশিয়া
পূর্বে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ: ৪ বার
সেরা সাফল্য: ১৯৯৮ বিশ্বকাপে তৃতীয়স্থান
ফিফা র্যাঙ্কিং: ২০
রাশিয়া বিশ্বকাপে ‘ডার্ক হর্স’দের অন্যতম ক্রোয়েশিয়া। গ্রীসের বিপক্ষে প্লে-অফ ও প্রীতি ম্যাচে ব্রাজিলের কাছে হেরেছে ঠিকই। কিন্তু মূল আসরে যেকোনো দলকে চমকে দেয়ার দারুণ সম্ভাবনা আছে ক্রোয়েটদের।
দলের মূল তারকা রিয়াল মাদ্রিদ মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচ। তাকে সাহায্য করতে আছেন বার্সা মিডফিল্ডার ইভান রাকিটিচ, জুভেন্টাস ফরোয়ার্ড মারিও মানজুকিচ, ইন্টার মিলান ফরোয়ার্ড ইভান পেরিসিচদের মতো বড় নাম।
মদ্রিচদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল তারা পড়েছেন এক কঠিন গ্রুপে। গ্রুপ পর্ব পেরোতে হলে মাঝমাঠে আধিপত্য দেখাতে হবে ক্রোয়েটদের। আর এই গ্রুপে সবচেয়ে সেরা মাঝমাঠ কিন্তু ইউরোপের এই দলটিরই।
কোথায় শক্তি?
দলে প্রতিভার ছড়াছড়ি। প্রত্যেকেরই ক্ষমতা আছে ম্যাচের ফল ঘুরিয়ে দেয়ার। ইউরোপের বড় বড় দলে খেলা ফুটবলাররা নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে জানেন ভালো ভাবেই।
কোথায় দূর্বলতা?
তারকা থাকলেও নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার একটা বিশাল শূন্যতা যেন রয়ে গেছে ক্রোয়েশিয়া দলে। সঙ্গে প্রীতিতে ব্রাজিলের কাছে হারায় ম্যাচে অগোছালো ভাবের দেখা মিলেছে। প্রস্তুতিও ভাল হয়নি ক্রোয়েটদের।
আইসল্যান্ড
বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ: প্রথমবার
ফিফা র্যাঙ্কিং: ২২
আগে কখনোই বিশ্বকাপ খেলা হয়নি কিন্তু ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে সেরা ২৫’র মধ্যে অবস্থান দলটির। ৩ লাখ ৩০ হাজার জনসংখ্যার আইসল্যান্ড ফুটবলে কতটা শক্ত অবস্থানে আছে এতেই বোঝা যায়। বাঘা বাঘা দলকে পেছনে ফেলে ২০১৬ ইউরোর কোয়ার্টারে চলে গিয়েছিল দলটি। ইউরোপ থেকে সবার আগে মূলপর্বে পা পড়েছে স্ট্রাকামির ওক্কার দলের।
দলে ছোটখাটো সমস্যা আছে ঠিকই তবে আইসল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের একতা। একটা দল হয়েই ইউরো, বাছাইপর্ব খেলে বিশ্বকাপে এসেছে তারা।
আর্জেন্টিনা, ক্রোয়েশিয়া ও নাইজেরিয়াকে নিয়ে আইসল্যান্ড কঠিন গ্রুপে পড়েছে; তবে ফুটবলে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। আর্জেন্টিনাকে আইসল্যান্ড রুখে দিতে পারবে না এমন কথা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না একজন ফুটবলবোদ্ধাও। আর বাছাইপর্বে ক্রোয়েশিয়াকে হারানোর অভিজ্ঞতা আছে ইউরোপের পুঁচকে দেশটি।
কোথায় শক্তি?
আইসল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শক্তি ‘দলীয় শক্তি’। ইউরোর মতো টুর্নামেন্টে খেলার অভিজ্ঞতা থাকায় বিশ্বকাপে ভেঙ্গে পড়ার কথা নয় দলটির। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াও দারুণ।
কোথায় দূর্বলতা?
আইসল্যান্ড এখন চমক জাগানো এক নাম। তাই ছোট দল বলে পার পেয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই তাদেরও। বড় দলগুলি নিজেদের সেরাটা দিয়েই চেষ্টা করবে আইসল্যান্ডকে রুখে দিতে। সেই চাপটা মোকাবেলা করার খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই, ভেঙে পড়ার সম্ভাবনাও তাই প্রবল।
নাইজেরিয়া
পূর্বে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ: ৫ বার
সেরা সাফল্য: ১৯৯৪, ১৯৯৮ ও ২০১৪ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় পর্ব পেরোনো
ফিফা র্যাঙ্কিং: ৪৮
আফ্রিকার সুপার ঈগলরা বিশ্বকাপে এসেছে নিচের দিকের র্যাঙ্কিং, আর নিজেদের প্রমাণের তাড়না নিয়ে। আর সে পথে বেশ কঠিন পরীক্ষাই দিতে হবে আফ্রিকান জায়ান্টদের।
আফ্রিকা থেকে সবার আগে বিশ্বকাপের টিকিট কাটা নাইজেরিয়া দলে আছেন আর্সেনাল তারকা অ্যালেক্স আইয়ূবি, চেলসি ফরোয়ার্ড ভিক্টর মোজেস ও লেস্টার সিটির কেলেচি ইহিয়ানচোর মতো তারকারা। গত বছর আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ৪-২ গোলের জয় নিশ্চিত অনুপ্রেরণা যোগাবে দলটিকে।
কোথায় শক্তি?
র্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকাটাই বড় শক্তি হতে পারে নাইজেরিয়ার জন্য। প্রত্যাশা কম, চাপও থাকবে খানিকটা কম। নির্ভার খেলা বের করে আনতে পারে বিশেষ পারফরম্যান্স।
কোথায় দূর্বলতা?
রক্ষণে বিশাল গলদ আছে সুপার ঈগলদের। দুই ইউরোপিয়ান দল আর আর্জেন্টিনার মতো দলের আক্রমণের সামনে কতক্ষণ টিকে থাকবে নাইজাররা, সেটাই আলোচনার প্রসঙ্গ।
এই গ্রুপ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডের সম্ভাব্য দল
আর্জেন্টিনা পরিষ্কার ফেবারিট হলেও গ্রুপসেরা হয়েই পরের রাউন্ডে যাবে এমন নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না। আইসল্যান্ড কিংবা ক্রোয়েশিয়াও পিছিয়ে নেই কেউ কারো থেকে। নাইজেরিয়ার আছে গত বিশ্বকাপে নকআউট পেরোনোর অভিজ্ঞতা। গ্রুপ অব ডেথে বাজি ঘোড়া নয় কোনো দলই।
গ্রুপ সূচি-
জুন ১৬: আর্জেন্টিনা-আইসল্যান্ড (সন্ধ্যা ৭টা)
জুন ১৬: ক্রোয়েশিয়া-নাইজেরিয়া (রাত ১টা)
জুন ২১: আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া (রাত ১টা)
জুন ২১: নাইজেরিয়া-আইসল্যান্ড (রাত ৯টা)
জুন ২৬: আইসল্যান্ড-ক্রোয়েশিয়া (রাত ১২টা)
জুন ২৬: আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া (রাত ১২টা)