চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

গ্রামে গঞ্জে সামাজিক অবক্ষয়: কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার

গ্রাম বলতে যে জায়গাটির কথা চোখের সামনে নিমিষেই ভেসে আসে তা হল: ছায়া, সুনিবিড়ি, শান্ত পরিবেশ যেখানে পরম শীতল ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বসবাসকৃত মানুষেরা সকল ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশেষ করে অপরাধগত ইস্যু থেকে নিজেদের দূরে রেখে স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত থাকেন। সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ, পারস্পারিক বোঝাপড়া, নীতি-নৈতিকতার মিশেলে এক চমৎকার হৃদ্যতার মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায় গ্রামীণ পরিবেশে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এবং সময়ের ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন ও পরিবর্ধনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামীণ আবহে অপরাধের কালিমালেপনে ক্রমে ক্রমে গ্রাম ও এতে বসবাসকৃত মানুষেরা অপরাধের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে। শুধু কি সামাজিক অবক্ষয়; পাশাপাশি নানাবিধ অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে বিশেষ করে স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা। যার ফলে সমাজে দেখা দিচ্ছে অস্থিরতা, ভেঙ্গে পড়ছে চিরায়ত সামাজিক কাঠামো। ফলশ্রুতিতে পারস্পারিক ক্লেশ, বিদ্বেষ, হিংসা ইত্যাদির কারণে সামাজিক অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে অপরাধের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে নষ্ট হচ্ছে সামাজিক সম্প্রীতি, সৃষ্টি হচ্ছে বৈষম্যমূলক সমাজের, বৃদ্ধি পাচ্ছে অপরাধ এবং অপরাধীর সংখ্যাও।

গ্রামীণ সমাজের উপর আলোকপাত করলে দেখা যায়, স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা অর্থাৎ কিশোররা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা অপরাধের সাথে নিজেদের যুক্ত করে ফেলছে। বর্তমান গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় এমন একটা মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে যার ফলশ্রুতিতে বখাটে ছেলেদের সাথে স্কুলগামী ছেলেদের অসম সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার দরুণ বিশৃঙ্খলামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেদের যুক্ত করে বিধায় পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটছে মারাত্মকভাবে। নেশার জগতে পা রাখার মধ্য দিয়ে অপরাধের দিকে ধাবিত হয়ে থাকে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। সিগারেট ফোঁকার মধ্য দিয়ে শুরু হয় নেশার যাত্রাপথ, পর্যায়ক্রমে গাঁজা সেবনের পাশাপাশি মাদকের প্রচার প্রসার লক্ষ্য করা যায় গ্রামীণ সমাজে। ইয়াবাসহ হিরোইন, ফেনসিডিল, প্যাথেইন ও দেশি বিদেশি মাদক দ্রব্যের সমাহারে সয়লাব গ্রামীণ সমাজ। আধুনিকতার নেতিবাচক প্রথাগুলোকে নিজেদের মধ্যে বপন করা তরুণ ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া বিমুখ হয়ে পড়ায় অপরাধ ও এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থতার হারও বেড়ে চলছে যা ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রার জন্য মারত্মক হুমকিস্বরূপ।

কি কারণে নেশাজাতীয় বস্তুর প্রসার ঘটছে তার কার্যকারণ সম্পর্ক বের করা অবশ্যাম্ভাবী হয়ে পড়ছে। কেননা, কারণগুলো বের করতে পারলেই সমাধানের পথ অনেকটা সহজতর হয়। মূলত কয়েকটি কারণকে উপজীব্য হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত: নেশার প্রতি আগ্রহ ও পিয়ার গ্রুপের সহযোগিতায় ছাত্র-ছাত্রীরা নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে; দ্বিতীয়ত: নেশাজাতীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতা ও দামের স্বাভাবিকতার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা সহজেই নেশায় মত্ত হয়ে পড়ে; তৃতীয়ত: পারিবারিক বন্ধনের অভাব ও সামাজিক বেষ্টনির অপ্রতুলতা; চতুর্থত: হতাশা, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, প্রেমে ‘ছ্যাঁকা’, স্কুলে পড়াশোনায় অমনোযোগী, বেকার হওয়ার দুশ্চিন্তা ইত্যাদি কারণে গ্রামে গঞ্জের সহজ সরল ছেলেমেয়েরা মাদকরূপী মরণনেশায় মত্ত হয়ে উঠছে এবং শেষত: বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে চলা তথা মাদকাসক্ততা নিজস্ব ক্রেডিট মনে করে অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন।

ভিন্ন প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে দেখা যায়, গ্রামীণ সমাজে পূর্বে পাড়ায় বিভিন্ন রকমের খেলাধূলা যেমন: দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, চুর-পুলিশ, ক্রিকেট, ফুটবল খেলার প্রচলন ছিলো। কিন্তু এখন খুব কম গ্রামই আছে যেখানে উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েরা বিকালের সময়টা খেলাধূলার পিছনে ব্যয় করেন। তাই সুস্থ চিন্তা এবং স্বাভাবিক বিকাশের পথও দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। এর পিছনেও নানামুখী কারণ রয়েছে: নগরায়ন, শিল্পায়নের ফলে শিল্প কারখানা গড়ে উঠা, যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবারে রূপান্তর, ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা, আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে কাজে নেমে পড়া, সহিংস আচরণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি কারণেও গ্রামীণ আবহের ছেলেমেয়েরা নানামুখী খারাপ কাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

মাদক জাতীয় দ্রব্যের কুপ্রভাব গোটা সমাজকে কুলষিত করে ফেলছে। ব্যক্তিক, পারিবারিক, গোটা সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের স্বাভাবিকতাকে নষ্ট করে দেয়, রুদ্ধ করে দেয় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, ব্যাহত হয় প্রাতিস্বিক আচরণগত বৈশিষ্ট্য। বাধাগ্রস্থ হয় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, পিতা-পুত্র সম্পর্ক, সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক, প্রতিবেশীর সাথে প্রতিবেশীর সম্পর্ক, ছেদ ঘটে আত্মীয়করণে। পাশাপাশি কিশোর বয়সে নেশাজাতীয় দ্রব্যের যোগান মেটাতে হেন কোন কাজ নেই যা তারা করে না। যার কারণে গ্রামে-গঞ্জে ছিনতাই, চুরি বিশেষ করে পুকুরের মাছ চুরি, ডাকাতি, সালিশে টাকা আদায় ইত্যাদি নৈমিত্তিক ঘটনা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্যও লক্ষ্যণীয়।

মাদকাসক্তি বর্তমানে সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এটি বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে ব্যক্তিগত, পরিবার এবং সামাজিক অবয়বে। সর্বশেষ দাখিলকৃত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশে ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ মাদকাসক্ত এবং প্রতিদিন এ গর্হিত কাজে ৭ কোটি টাকার উপরে অপচয় হচ্ছে। আবার অন্য এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাদকাসক্তরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায় কিন্তু ৮২ শতাংশ আসক্তরা সুস্থ সুন্দর জীবনে ফিরে আসতে পারে না। বাংলাদেশে পিয়ার গ্রুপের প্ররোচনা ও মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা মাদকাসক্তের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত। গ্রামের ন্যায় শহরের অবস্থাও ভয়াবহ, এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকা শহরের ৫০০০ পয়েন্টে মাদকদ্রব্য কেনা বেচা হয়ে থাকে। তাই যত দ্রুত সম্ভব মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে বহুমুখী ও জীবনমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অবশ্যাম্ভাবী। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা খুবই প্রাসঙ্গিক হওয়া প্রয়োজন যেখানে তাদের ভূমিকা নিয়ে বারংবার প্রশ্ন দেখা দেয়।

গ্রামে-গঞ্জে টিম ভিত্তিক কাজ করে কতিপয় গ্রুপ মাদকের প্রচার এবং প্রসারে। শোনা যায়, স্থানীয় সব প্রশাসনের সাথে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করে মাদকের ভয়াবহতাকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় উঠতি বয়সী যুবকদের মাঝে। গাঁজা সেবনের মাধ্যমে শুরু হয়ে থাকে প্রাথমিক পর্ব। পরবর্তীতে আরো ধ্বংসাত্মক মাদকের দিকে ছুটে যায় স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা। গ্রামীণ পর্যায়ের অবক্ষয় চরম আকারে ধারণ করেছে যেখানে শিক্ষকদের সামনে ছাত্ররা সিগারেট খাচ্ছে। মাদকাসক্তদের শাসন করতেও ভয় পাচ্ছে শিক্ষকেরা। অভিভাবকেরাও ছেলেদের শাসনের মধ্যে রাখতে পারছে না। কারণ, মাদকাসক্তদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে থাকে প্রভাবশালীরা বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা। মিছিল, মিটিং এ গণজমায়েতের পিছনে মাদকাসক্তরাই সাহায্য করে থাকে কতিপয় ব্যক্তিদের। এহেন অবস্থা চলতে থাকলে সামাজিক অবক্ষয় সকল ধরনের মাত্রা অতিক্রম করে যাবে যা সমাজের স্বাভাবিক জীবনাচরণের জন্য অভিশাপ।

গ্রামীণ সমাজের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তথা মাদকের ভয়াবহতা থেকে যুবক ছেলেদের দূরে রাখতে সামষ্টিকভাবে ঐক্যমতের ভিত্তিতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। পরিবার কেন্দ্রিক প্রাত্যহিক শিক্ষাটাকে জোরদার করবার নিমিত্তে মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। কারণ পরিবারই প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে থাকে। পরিবারের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও এর উপর তদারকি পূর্বের ন্যায় বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের মর্যাদা পুন:প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যে সমাজে বা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষককে হেয় করা হয় সেখান থেকে ইতিবাচক ফলাফল আশা করাটা খুবই দুষ্কর। তাই শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং তাদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে উন্নয়ন এবং সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের স্বার্থেই। প্রতিবেশী এবং সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে সম্পর্কন্নোয়ন ও মূল্যবোধ বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের সাথে সাথে শিশুদের মানসিক সুস্থতা ও বিকাশের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের গণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জে সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করা সম্ভবপর হবে। অন্যথায় রাষ্ট্রের ঘোর বিপদ আসন্ন।

এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)