রাজধানীর বকশিবাজারে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের মূল গেট দিয়ে ঢোকার সময় বাম দিকে ফুটপাথে দু’টি ছোট টেবিল। এগুলোর পাশেই গেটের একেবারে কাছেই পান-সিগারেটের দোকানে বেশ ভিড়। কাছে গিয়ে দেখা যায় পান-সিগারেটের দোকানীর হাতে এস.এস.সি, এইচএসসি’র প্রবেশপত্র, রেজিস্ট্রেশনের কাগজের ফটোকপি তুলে দিচ্ছে কয়েকজন। সিগারেটের দোকানে ঝুঁলছে একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা আছে ‘বিসমিল্লাহ ইনফরমেশন মিডিয়া’।
সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে এই দোকানীকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘সার্টিফিকেটে নামের বানান ভুল খুব তাড়াতাড়ি সংশোধন করার কোনো ভিন্ন উপায় আছে কিনা?’
জবাবে লাল রঙের সিগারেট ট্রলির একেবারের নিচের তাক থেকে সরকারি কাজে ব্যবহার হয় এমন কাগজে শিক্ষাবোর্ডের মনোগ্রামে ছাপা ফর্ম বের করে দিলেন দোকানী। সঙ্গে দিলেন একটি ভিজিটিং কার্ডও। সেই কার্ডে মো. সিরাজুল ইসলামের নাম লেখা, নামের নিচেই ছোট করে লেখা ‘স্টাফ রিপোর্টার’। তবে সিরাজুল আসলে কোন পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার সেটি কার্ড দেখে বোঝার উপায় নেই। কারণ নয়াদিগন্ত থেকে শুরু করে দৈনিক সোনালী বার্তা, দৈনিক মাতৃভাষা, দৈনিক আলো বার্তা নামের জানা-অজানা পত্রিকার নাম লেখা এই কার্ডে।
তার সঙ্গে যখন এই প্রতিবেদক ‘কত দিলে তাড়াতাড়ি পাবো’ এই আলাপে ব্যস্ত তখন সামনে দাঁড়ানোদের ফটোকপি, ভুল সংশোধনের পূরণ করা ফর্ম জমা নিতে ব্যস্ত সিগারেট দোকানদার-কাম স্টাফ রিপোর্টার সিরাজুল। এসবের ফাঁকে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘১৫ হাজার দিলে যত তাড়াতাড়ি চাইতাছেন পায়া যাইবেন।’
এতটাকা দেয়া কঠিন হয়ে যাবে জানিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে এই প্রতিবেদক গেলেন কাছেই আরেকটি টেবিলে। কোনো সাইনবোর্ড দেখা গেলো না। এখানেও ‘সার্টিফিকেটের ভুল ঠিক করবো’ জানালে একটি কার্ড পাওয়া গেলো। কার্ডে নাম লেখা মাহাবুব আলম। তিনিও ‘স্টাফ রিপোর্টার’। এখানেও যে তড়িৎ ‘সেবা’ দেয়া হয় তা বোঝা গেলো জোরেশোরে দরকষাকষি দেখে। মাহাবুবের বেঁধে দেয়া ১৫’শ টাকা ফি কমিয়ে হাজার-১২’শ করতে চড়া গলায় দামদামি করছেন দুই মধ্যবয়সী ব্যক্তি। অবশেষে ১৩’শ টাকায় কাজ হবে জানার পর নাম, ফোন নম্বর লেনদেন শেষে শান্ত হলো পরিবেশ।
কিছুদূর তাদেরকে অনুসরণ করে পরিচয় দিতে তারা সবখুলে বলেন। ছেলের সার্টিফিকেটের ভুল দ্রুত সংশোধন করতে এমন প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হয়েছে বলে জানান জুলফিকার আলী।
তিনি বলেন,‘বোর্ডের কাজে অনেক সময় লেগে যায়। অথচ সার্টিফিকেটের ভুলটি দ্রুত সংশোধন না করলেই নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। কয়েকদিন পরপর বোর্ডে এসে এই টেবিল-ওই টেবিলে দৌঁড়ানো সম্ভব নয়। তাছাড়া এখানে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আদৌ নিয়ম মেনে এসব করবে বলে মনে হয় না। তারা ইচ্ছে করেই ধীর গতিতে কাজ করে আমাদেরকে ভোগায়। এই যে বাইরে এসব টেবিল এগুলো তাদের এই ঢিলেঢালা কাজের সুযোগে বাড়তি আয়ের অবৈধ উৎস। এসব টাকার ভাগবাটোয়ারা অনেক ওপর পর্যন্ত যায় বলেই বোর্ডের সামনেই এসব চলে।’
এই অভিভাবকের এমন অভিযোগ যাচাই করতে শিক্ষা বোর্ডের ভেতরে যান এই প্রতিবেদক।
৪ নম্বর ভবনের ভেতর থেকে বের হওয়া ফাইল নিয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকা একজন কর্মচারীর হাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই প্রতিবেদক পরিচয় গোপন করে জানতে চান, ‘একটু বেশি টাকা দিয়ে হলেও ২ সপ্তাহের মধ্যে সার্টিফিকেটের ভুল ঠিক করাতে কার সঙ্গে কথা বলবো?’।
প্রথমে এই কর্মচারী কিছু জানেন না বললেও একটু পরেই বলেন, ‘আসুন আমার সঙ্গে।’
৪ নম্বর ভবনের সামনেই তিনি পরিচয় করিয়ে দেন জিল্লু নামের শিক্ষাবোর্ডের একজন কর্মচারীর সঙ্গে। তিনি জানান ৭-৮ হাজার টাকাতেই সব করে দিতে পারবেন তিনি। মোবাইলফোন নম্বরটিও দিয়ে দিলেন তিনি।
হেল্প ডেস্ক নিয়েও শোনা গেলো অভিযোগ। হেল্প ডেস্ক থেকেই বাইরের টেবিলের ঠিকানা পাওয়া যায় বলে জানান কয়েকজিন ভুক্তভোগী।
বোর্ডের হেল্প ডেস্ক থেকে ফুটপাথে মাহাবুবের টেবিলের খোঁজ পাওয়া মিতুল এবং তার সঙ্গে থাকা বড় ভাই জানায়, ‘পর পর দুইদিন এখানে এসেছি। কলেজে ভর্তির জন্য হারিয়ে যাওয়া প্রবেশপত্র তুলতে। প্রথমদিন হেল্প ডেস্কে আমাদের কথাই শুনছিলেন না চেয়ারে বসা ব্যক্তিটি। হেল্পডেস্কে পাঞ্জাবী পরা আরেক লোক ৭ হাজার টাকা পেলে কাজ করে দেবেন বলে জানান।’
শিক্ষা বোর্ডের ৪ নম্বর ভবনের ৫ম তলায় সার্টিফিকেট শাখার বাড়তি কামাইয়ের কথা শোনা গেলো গেটের বাইরে চায়ের দোকানে।
ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলিজিয়েট স্কুলের অফিস কর্মচারী গোলাম মোস্তফা জানান, স্কুলের ছাত্রের হারানো সার্টিফিকেট তুলতে ২-৩ ঘণ্টা তাকে এই টেবিল-ওই টেবিল করতে হলেও কাজ হয়নি। ৪ নম্বর ভবনের ৫ম তলার সার্টিফিকেট শাখায় চেয়ারে বসা একজন বলেন, ‘খরচপাতি দিলে কাজ হবে।’
খোদ শিক্ষাবোর্ডের ভেতরে-বাইরে বিনামূল্যে সেবা দেয়ার বদলে এতো টাকার নগদ লেনদেন চলছে। তখন বোর্ডের ওয়েবসাইটে একটি সতর্কীকরণ বার্তায় বলা হচ্ছে: “লক্ষ করা যাচ্ছে বোর্ডের বিভিন্ন সেবা প্রদানের কথা বলে সেবা গ্রহণকারীর নিকট থেকে প্রতারকচক্র নামে-বেনামে ফোন করে নগদ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। বোর্ডের কোন কাজের জন্য নগদ অর্থ গ্রহণ করা হয় না”।
তবুও বোর্ডের গেটে এবং ভেতরে প্রকাশ লেনদেন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বোর্ড সচিব শাহেদুল খবির চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘ফুটপাথের এসব দোকান আমাদের এখতিয়ারের মধ্যে নয়। কেউ অভিযোগ করলে এসব সরাতে আমরা সিটি কর্পোরেশনকে অবহিত করতে পারি।’
কিভাবে সিগারেটের দোকানে সরকারি কাগজের ফর্ম আসছে তা জানেন না জানিয়ে তিনি বলেন,‘ কর্ণফুলী পেপার বাইরেও বিক্রি হয়। সেসবেই হয়তো প্রিন্ট করানো হয়েছে ফর্মগুলো। বোর্ডে আবেদন করার জন্য আমরা অনলাইনেই ফর্ম রেখেছি।’
বোর্ডের গেটের বাইরেই নগদ লেনদেন এবং ভেতরের অসাধু চক্রের খণ্ডচিত্র ধরা পড়ে চ্যানেল আই অনলাইনের গোপন ক্যামেরায়: