ধরুন আপনার বাসার ১২ বছরের কাজের মেয়েটি একদিন হঠাৎ হারিয়ে গেলো। আপনি তখন কি করবেন? নিশ্চয়ই আপনি মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াবেন না; কিংবা সকাল-বিকেল অফিস করবেন ঠিক’ই কিন্তু ওই কাজের মেয়ের কোন খোঁজ করবেন না!
আজ পত্রিকায় একটা সংবাদ ছাপা হয়েছে। এক বিচারক এবং তার স্ত্রী মিলে তাদের বাসার কাজের মেয়েকে নিয়মিত নির্যাতন করে আসছেন। ওই কাজের মেয়ের দেহে একাধিক ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই মেয়ে দেড় বছর ধরে ওই বাসায় কাজ করতো।
শেষমেশ কাজের মেয়েটি কোন ভাবে পালিয়ে গিয়ে বেঁচে গেছে! অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ওই বিচারক’কে যখন সাংবাদিক ফোন করে তার বাসার কাজের মেয়ে সম্পর্কে জানতে চান, তিনি বলেন -‘আমি ঢাকার বাইরে আছি। শুনেছি বাসার কাজের মেয়েটা পালিয়েছে। বাসার ঘটনার বিষয়ে এখন কিছু বলতে পারছি না!’
বাহ, কি চমৎকার! তার বাসার মেয়েটিকে পাওয়া যাচ্ছে না, আর তিনি ঢাকার বাহিরে হাওয়া খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! তিনি কিছুই বলতে পারছেন না! তিনি কি নিশ্চিত ছিলেন মেয়েটি পালিয়েছে? মেয়েটি তো হারিয়েও যেতে পারতো, কোন খারাপ কিছুও তো হয়ে যেতে পারতো। তিনি পুলিশের কাছে গেলেন না, খোঁজ খবর করলেন না; দিব্যি ঢাকার বাহিরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! ভাবখানা এমন-আমার বাসার কাজের মেয়েকে দরকার হয় আমি মেরে ফেলবো, তাতে তোমাদের কি?
কয়েকটি ঘটনার কথা এখানে বলতেই হচ্ছে- কিছু দিন আগে সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শিক্ষকদের গায়ে হাত দিয়েছিলো; এর মাঝে দেখলাম এক ম্যাজিস্ট্রেট দুই মেডিকেল রিপ্রেজেণ্টটেটিভ’কে প্রকাশ্য দিবালোকে কানে ধরে উঠবস করাচ্ছেন; আরেক এমপি তো রীতিমত এক শিশুর পায়ে গুলি করে তার নিশানা ঠিক করছিলেন।
এই যে এই সব ঘটনা ঘটছে, অনেকে হয়তো মনে করবে; একটা দুটো ঘটছে, এ আরে এমন কি!তবে সমাজে এর প্রভাব কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী।
একজন শিশু যে কিনা এ সব কিছু দেখে শিখছে, সে কিন্তু দেখছে একজন বিচারক এই কাজ করছে কিংবা একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা এমপি! অর্থাৎ যেই শিশু বড় হয়ে বিচারক কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট হতে চায়; সে দেখছে তার আদর্শের জায়গা থাকা মানুষগুলো এই ধরনের কাজ করছে। এর প্রভাব তার উপর পড়বে। সে যখন বড় হবে তখন তার জন্যও হয়তো অন্যদের উপর নির্যাতন করা’টা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হবে।
আমার তো কেন যেন মনে হয় আমাদের চিন্তা ভাবেনা কিংবা সভ্যতার বিষয় গুলো ক্ষেত্র বিশেষে কেবল শব্দ পরিবর্তনের মাঝে এসে ঠেকে গেছে! এই যেমন আজকাল কাজের মেয়ে’দের বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও গণমাধ্যম গুলো একটু ভদ্রভাষায় লিখে ‘গৃহকর্মী” হিসেবে বলে থাকে; কিংবা একসময় নারী যৌনকর্মীদের পত্রিকায় লেখা হতো ‘পতিতা’, এখন পুরো পৃথিবীব্যাপী বলা হয় “যৌনকর্মী!” অর্থাৎ পেশা বা কাজের একটা স্বীকৃতি দেবার চেষ্টা। এটি অবশ্যই একটি ভালো দিক। কিন্তু শব্দ পরিবর্তন করে তো সভ্য হওয়া যায় না। সভ্য হওয়ার জন্য মানসিকতার পরিবর্তনও করতে হবে।
একটা বিষয় বলি, কাজের মেয়ে তো দূরে থাক, পশ্চিমা দেশ গুলোতে আপনি যদি নিজের ছেলে-মেয়েকেও শারীরিক ভাবে আঘাত করেন এবং সন্তান যদি মনে করে এটি শারীরিক আঘাত; সে পুলিশে ফোন করে যদি এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, তাহলে আপনি যদি দেশের প্রেসিডেন্টও হয়ে থাকেন; আইন অনুযায়ী আপনার শাস্তি হবে। আর বাংলাদেশে একজন বিচারক তার বাসার কাজের মেয়েকে দিনের পর দিন নির্যাতন করে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারেন! ম্যাজিস্ট্রেট প্রকাশ্য দিবালোকে বিনা বিচারে লোকজনদের কানে ধরে উঠবস করাতে পারেন!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)