গৃহঋণ বিতরণে শহরের গ্রাহক ও গ্রামের গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ করা গেছে। বিতরণকৃত মোট গৃহঋণের প্রায় ৮৪ শতাংশ পায় শহরের গ্রাহক আর মাত্র ১৬ শতাংশ পায় গ্রামের গ্রাহক। গৃহঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপকদের প্রস্তুত করা প্রবন্ধে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএম আয়োজিত ‘হোমলোন অব ব্যাংকস: ট্রেন্ড অ্যান্ড ইমপ্যাক্ট’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির অধ্যাপক এবং পরিচালক মহিউদ্দিন সিদ্দিক, সহযোগী অধ্যাপক মো. আলমগীর এবং ড. মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
এতে তারা বলেন, অন্যান্য সব ঋণের চেয়ে গৃহঋণে খেলাপি সবচেয়ে কম। ২০০৬ সালে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের হার ছিল ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। তখন গৃহঋণে খেলাপি ছিল ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর ২০১৬ সালে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। যেখানে গৃহঋণে তা হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ১২ শতাংশ।
মূল প্রবন্ধে আরো বলা হয়েছে, গৃহঋণের অধিকাংশই পায় শহরের মানুষ। ঋণ বিতরণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মোট ঋণের ৮৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ পায় শহরের মানুষ। আর গ্রামের মানুষ পায় মাত্র সাড়ে ১৬ শতাংশ। এই ঋণের অধিকাংশ অর্থই ব্যয় হয় বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে।
বৈঠকে বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, গৃহঋণ বিতরণের পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। তবে এই ঋণ হতে হবে স্বল্পসুদের। গ্রামের মানুষ যেন ঋণ পায়- সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ গৃহঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শহরে ও গ্রামে বড় ব্যবধান রয়েছে।
বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলী বলেন, অসাধু আবাসন ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট তৈরি করে বিক্রি করেছে; কিন্তু তার রেজিস্ট্রেশন দেয়নি। এর কারণ হচ্ছে, তারা লোন পরিশোধ করছে না। তাই রেজিস্ট্রেশনও দিতে পারছে না। এ বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া জরুরি।
ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঋণ প্রদানে বড় ধরনের বৈষম্য রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যাংকের উঁচু স্তরের কর্মকর্তারা ২ থেকে ৩ শতাংশ সুদে ঋণ নিচ্ছে। অথচ নিচের স্তরের কর্মকর্তারা ঋণই পায় না। ব্যাংকের বড় বড় কর্মকর্তারা এই বৈষম্য বাড়া্চ্ছেন। এই বৈষম্য বন্ধ করতে হবে।
আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা গৃহ ঋণের অপব্যবহার করছেন অভিযোগ করে তিনি অধ্যাপক ইয়াছিন আলী বলেন, ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর, ইউএসএ এবং সুইজারল্যান্ডে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানতের অর্থ নানা কৌশলে বিদেশে অর্থ পাচার করে সেখানে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছে তারা। অথচ এই অর্থ দেশে থাকলে অর্থনীতি আরো চাঙ্গা হতো।
পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমদ চৌধুরী বলেন, ফ্ল্যাট বা বাড়ি রেজিস্ট্রেশন করার সময় ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ (বন্ধক) আছে কি না- তা শতভাগ নিশ্চিত হতে হবে। কারণ অনেক ব্যবসায়ী এবং বাড়ির মালিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে্ও তা সাইনবোর্ডে উল্লেখ করেন না। এছাড়া গৃহঋণে প্রভিশন ২ শতাংশের জায়গায় ১ শতাংশ হলে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে আরও উৎসাহ বোধ করবে বলে মনে করেন তিনি।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের কান্ট্রি হেড আব্রার আনোয়ার বলেন, গৃহঋণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে উচ্চ সুদ বড় বাধা। এই সুদ হার কমিয়ে আনা দরকার। একইসঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশিদের গৃহঋণের সুযোগ দেয়া উচিত।
আলোচনা শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস.কে. সুর চৌধুরী বলেন, মানুষ গৃহ নির্মাণে যাতে সহজে ঋণ পায়- সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে শর্ত সহজ ও সুদ কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে মধ্যবিত্তরা মাথাগোজার ঠাঁই করতে পারেন। এ সময় গৃহঋণের নানা দিক বিশ্লেষণ করে নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে বলে জানান তিনি।