ঘুমের মধ্যেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন সর্বজন সম্মানিত জাতীয় অধ্যাপক জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। যিনি সবার কাছে ‘জেআরসি স্যার’ নামে পরিচিত ছিলেন। অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, তথ্য-প্রযুক্তিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। এছাড়াও তিনি আর্থকোয়েক সোসাইটি, পরিবেশ আন্দোলন বাপা এবং গণিত অলিম্পিয়াডের মতো বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি টাস্কফোর্সের একজন সদস্য ছিলেন তিনি।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কয়েক লাখ শিক্ষার্থী ও গুণমুগ্ধ রেখে গেছেন এই শিক্ষাবিদ। তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং সরাসরি ছাত্র ছিলেন ড. নাভিদ সালেহ, যিনি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে অধ্যাপনা করছেন। প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুতে শোক জানানোর পাশাপাশি স্মৃতিকাতর হয়ে জানিয়েছেন প্রিয় ‘জেআরসি স্যার’ এর নানা কথা।
চ্যানেল আই অনলাইন পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
“জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার-এর সাফল্য, তাঁর গড়া প্রকল্পের ফর্দ, আর প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা প্রকাশ নিয়ে লেখার অভাব পড়বে না। একজন ছাত্রের মননে যিনি সাড়া দিয়েছেন, যে মহান শিক্ষক মনের বাতি জ্বেলে গেছেন নীরবে, আজ তাঁর প্রয়ানে আমি সেই ব্যক্তি-জামিল স্যার-কে তুলে ধরবার চেষ্টা করবো। এটি আমার তাঁকে নিয়ে একটি ব্যক্তিগত আখ্যান।
সেদিন ছিল ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুর। প্রখ্যাত জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার, যাঁকে আমরা ভালোবেসে JRC বলে জানি, প্রথম ক্লাস নিতে আসছেন আমাদের। আমি তখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরঃকৌশল অনুষদের চতূর্থ বর্ষের ছাত্র। মনীষার প্রতি আমার একটা প্রবল অনুরক্তি ছিল তখন। JRC স্যার ছিলেন বিদ্যা আর মনীষার কেতন। JRC-র ক্লাস করব’—এ ভাবনায় চমকিত আমি। তিনি ধীর পায়ে ক্লাসে প্রবেশ করলেন। হাতে বই, চক, আর মুখে নির্মল আকর্ণবিস্তৃত হাসি। মিনিট খানেকের ভেতরই স্যার-এর বুদ্ধির আঁচ এসে লাগলো। তিনি স্ট্রাকচারাল এনালিসিস এন্ড ডিসাইন-৩ পড়াবেন। বেশ জটিল খটমট একটি বিষয়। মুগ্ধ হবার প্রতীক্ষা ছিল, হলাম বিমোহিত। এমন সহজ, অথচ নিরেট খাঁটি একজন মানুষকে সামনাসামনি দেখিনি আগে। যাঁর বিদ্যায় কোনো ফাঁটল নেই, বাচনে নেই জড়তা, যাঁর স্মরণশক্তি প্রবাদতূল্য—সেই মহান মানুষটির জ্ঞানের প্রবাহে নিমজ্জিত হতে আকুল হলো চিত্ত। বাকি সেমেস্টার-এ স্যার ম্যাট্রিক্স ফর্মুলেশন পড়ালেন, মোমেন্ট ডিষ্ট্রিবিউশন মেথড শেখালেন। গোটাগোটা হাতের লেখায় বিশাল ম্যাট্রিক্স গড়তেন। বিষয়টির উপলব্ধি না হওয়া পর্যন্ত, স্যার অক্লান্ত চেষ্টায় ব্যাখ্যা করে যেতেন। JRC-স্যার-এর সংস্পর্শে এসে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন যেন সার্থক হলো আমার।
সেই শুরু। জামিল স্যার-এর সাথে যোগাযোগের জল, সম্পর্কে গড়ায়। যতবার দেশে গিয়েছি, জামিল স্যার সময় দিয়েছেন আমাকে। জানতে চেয়েছেন আমার গবেষণার কথা। পরামর্শ দিয়েছেন; পেশাগত এবং ব্যক্তিগত। স্যার-এর সাথে কথোপকথনে উঠে এসেছে প্রকৌশল বিদ্যার বিশ্বখ্যাত মনীষীদের গল্প। নানা সম্মেলনে তাঁদের সাথে স্যার-এর আলোচনার আখ্যান। জামিল স্যার-এর স্মরণশক্তি ছিল অনির্বচনীয়। কারো পুরো নাম কেবল নয়, তার নামের বানান অব্দি নির্ভুল বলে দিতেন, অনায়াসে। হোক সেই ব্যক্তি জার্মান কি রুশ। এমনি একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। জামিল স্যার বললেন, “তোমাদের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস-এর বর্তমান প্রধান কি Steven Fenves এর কিছু হন?” আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই স্যার ফেনভেস-এর স্টিল স্ট্রাকচারস-এ অবদানের নিখুত আর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে লাগলেন। এখনো কানে বাজে—স্যার-এর হাস্যোচ্ছল মুখে অবলিলায় বলে যাওয়া স্টিল স্ট্রাকচারস-এর তত্ত্বের কথা। স্যার-এর অসাধারণ গুণাবলীর ভিতর একটির উল্লেখ না করলেই নয়। একটি কথার সূত্র ধরে আরেকটি আপাত অপ্ৰাসংগিক উপাখ্যানকে একসাথে গেঁথে দেবার অসীম ক্ষমতা ছিল তাঁর। স্টিল স্ট্রাকচারস থেকে জল বিশোধণ, অথবা Fenves থেকে Stumm and Morgan। চিন্তার প্রবাহকে রুখে দেয় কে? বুদ্ধির দ্যুতি ছড়াতে ছড়াতে, শুরুর প্রসঙ্গটি কিন্তু ভুলে যাননি তিনি।আমাকে বললেন, “কই, দিলে না তো উত্তরটা?” ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস-এর বর্তমান প্রধান, Gregory Fenves-কে জানবার আগ্রহে মেতে ওঠেন স্যার। জানবার, আর তা মনে রাখবার এক অদম্য ক্ষুধা নিয়ে শ্রষ্টা পাঠিয়েছিলেন তাঁকে।
এই গুণী মানুষটি গুণের কদর করতে জানতেন। বিশ্বের কে কোথায় কি অর্জন করেছে, কার প্রযুক্তি প্রভাব ফেলেছে মানবকল্যানে, এ বিষয়ক তথ্য উপাত্তের কোনো কমতি ছিলোনা স্যার-এর কাছে। আমার সাথে দেখা হলেই গল্পের ঝুড়ি খুলে বসতেন। বাঙালি পরশ্রীকাতর, আমাদের জামিল স্যার-কে জানলে কেউ একথা বলবে না। অন্যের সাফল্যের জন্যে অনেক জায়গা ছিল এই বিশাল মানুষটির হৃদয়ে। তবে একথা বলতেই হয়, সব সফল মানুষদের মাঝে স্যার-এর কাছে অনেকটাই গুরুত্ব পেতো বুয়েটের এলুমনাইদের সাফল্য। শিশুসুলভ উচ্ছলতায় হেসে উঠতেন তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠানের নূতন কিংবা পুরাতন এলুমনাইদের কথা বলতে গিয়ে। গর্ব নিয়ে বলতেন, “বিজ্ঞানে বাংলাদেশের কেউ না কেউ নোবেলজয়ী হবেই, আগামী দুই দশকের ভেতর।”
আমাদের প্রিয় JRC স্যার তাঁর একটি নিবিড় আক্ষেপের কথা আমাকে বলেছেন অনেকবার। বাংলাদেশে, বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সামনে এগোনোর গতিকে শ্লথ মনে হয়েছে তাঁর কাছে। আমরা কেনো এশিয়ার বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পিছিয়ে? কি করে এগোবে তাঁর প্রাণের বুয়েট, আর বাংলাদেশের অন্যান্য বিদ্যাপীঠগুলো? এ বিশ্বিদ্যালয়গুলোর এলুমনাইদের কি করণীয়? এ প্রশ্নগুলো ভাবাতো তাঁকে। বাংলাদেশ যখন সাম্প্রতিক জীবাণু সংক্রমণের রোষ ঠেকাতে ব্যস্ত, জামিল স্যার মিটিং ডাকলেন বুয়েট এলুমনাইদের। জাতীয় ক্রান্তিকালে আমরা আমাদের এ বাতিঘরকে ছাড়া এগুবো কি করে?
আজ JRC স্যার-এর দেহত্যাগের বিষন্ন প্রহরে দাঁড়িয়ে কেবল তাঁর হাসিমাখা সরল মুখটির ছবি ভেসে উঠছে। তাঁর দ্যুতিময় চাহনি, নির্ভুল ইংরেজি আর সিলেটি টোন-এ বাংলা বলা, প্রখর স্মরণশক্তি, অনড় অভিমত, অথচ অকপট সারল্যেভরা অন্তর—এমন সম্মিলন আর কখনো খুঁজে পাবো কি? আর কখনো, আমার মুখ দর্শনে কেউ এভাবে উচ্ছসিত হয়ে উঠবে কি? নির্মল চিত্তে কেবল আমার মঙ্গল প্রার্থনায় আর কে এভাবে সুপরামর্শ দেবে? আমি আজ আমার একাডেমিক আর পেশাগত জীবনের এক পিতাকে হারিয়েছি। আর দেশ হারিয়েছে একটি বিরল নক্ষত্রকে।”