আমাদের দেশে ধর্মের নামে তাণ্ডব সৃষ্টির জন্য নাটক সাজানো নতুন নয়। ইন্ধন জোগানোর মানুষও কম নয়। ভোটের হিসাব নিকাশ বা আরও কিছু অদৃশ্য বা দুর্বোধ্য কারণ এখানে থাকতে পারে। এগুলো গবেষণা ছাড়া বলা যাবে না। তবে তাণ্ডব সৃষ্টির সাম্প্রতিক প্রবণতা হলো, বানানো গল্পের জন্য হতভাগ্য একটা নিরীহ চরিত্র আবিষ্কার করা। যিনি পরবর্তীতে ‘বলির পাঁঠা’ হিসাবে ব্যবহৃত হন। তাকে কেন্দ্র করেই প্রোপাগাণ্ডা ও নানামুখী সুতোর টানাটানি জুড়ে দিয়ে তাণ্ডবের ব্যাপক আয়োজন পূর্ণ করা হয়।মাথা খাটিয়ে দৃশ্যপট তৈরির পর শুরু হয় বাস্তব মঞ্চাভিনয়। এ যাবত সংখ্যালঘুদের বাড়ি, মন্দির বা টেম্পলে হামলার পূর্বলক্ষণগুলো একই রকমের।
মাস্টার মাইন্ড ও সহযোগীরা সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্ম-উন্মাদনা জাগ্রত করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। এজন্য তারা পরিকল্পিতভাবে ঘটনা তৈরি করে জাস্টিফিকেশন বানায়। উসকানির উপাদান ফিট করে গল্প বানানো তাদের একটা কমন প্যাটার্ন। গল্পের সূচনায় থাকে, ‘বলির পাঠা’ হিসাবে বেছে নেয়া প্রত্যন্ত এলাকার অখ্যাত কোনো একজন বৌদ্ধ বা হিন্দু সংখ্যালঘু। যিনি ইসলাম বা পবিত্র কোরআন অবমাননাকর কিছু একটা ফেসবুকে পোস্ট দিবেন। এরপর নানা রকমের হিসেবী আয়োজন ও প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে সংখ্যাগুরু সাধারণ মানুষকে আবেগপ্রবণ করে ক্ষেপিয়ে তোলা হবে। ক্লাইমেক্স তুঙ্গে উঠলে সংখ্যালঘুদের উপর নির্বিচার তাণ্ডবলীলায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। পরিস্থিতির এই ডামাডোলে বিভিন্ন গ্রুপ ও ব্যক্তির ফায়দা লিপ্সা যুক্ত হয়ে ধ্বংসলীলার মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আইনি প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার প্রক্রিয়া শুরু বা শেষ হওয়ার বহু আগেই তার সম্প্রদায় বা ধর্মীয় উপাসনালয় আক্রান্ত হয়।
নাসির নগরে তাণ্ডবের পর এখন অন্য কথা শোনা যাচ্ছে। শনিবার রাতে(৫নভেম্বর) টিভির খবরে মন্ত্রি ছায়েদুল হকের বক্তব্য শুনলাম। তিনি বলেছেন, রসরাজ দাস গরিব জেলে। সে ফেসবুক চালাতে জানে না, বড় জোর তার একটা মোবাইল থাকতে পারে। ঘটনা শেষ হওয়ার পর এখন বুদ্ধি আসতেছে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। কোর্টে রসরাজ দাসের পক্ষে কোনো উকিল দাঁড়াতে পারে নি। পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়েছে। রিমাণ্ডে কি হয় সবাই জানে!
এই সাম্প্রদায়িক শক্তির তাণ্ডব-কৌশল অনেকটা জামায়াত-শিবিরের মতো। কম সমর্থক নিয়েও সাধারণ মানুষকে গুজবের শক্তির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করে তাণ্ডব করা। জামায়াত-শিবির যেমন, সাঈদীকে চাঁদে দেখিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে কিংবা দেশব্যাপী তিন মাসের তাণ্ডব-নৈরাজ্যের বেশিরভাগ সময়টাতে ‘ফটোশপ’ করা ছবি এবং ভিডিও দেখিয়ে সাফল্যের সাথে ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজ ইত্যাদি আদায় করতে পেরেছে। সংখ্যালঘুদের উপর তাণ্ডবের ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাসিরনগরের আগের উদাহরণ রামু’র। ২০১২-তে সেখানে উপলক্ষ ছিল উত্তম কুমার বড়ুয়া। নাসিরনগরের ঘটনার অব্যবহিত পরপরই আরও কয়েকটি জায়গায় হিন্দুদের মন্দির ও বসতবাড়িতে হামলার খবর পাওয়া গেছে। এগুলো কিসের ইংগিত, সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে।
সংখ্যালঘুদের উপর হামলার মাধ্যমে এদেশে সমাজ ব্যবস্থায় বহু বছরের মূল্যবোধের অনুশীলনে তৈরি হওয়া সামাজিক সম্প্রীতি নিমিষেই ভূলুণ্ঠিত হয়। দুর্বৃত্তদের ইচ্ছাপূরণ হয়। সরকার বাহ্যিকভাবে আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দেয় বটে। কিন্তু দীর্ঘদিনের চর্চায় অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের যে উপাদানগুলো একটু একটু করে গড়ে উঠছিল, তারমধ্যে যে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি হল, তা নিরাময়ের ‘তালিসমান’ কি আমাদের আছে? ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনার প্রেক্ষিতে বলতে চাই- ঘটনা যা ঘটেছে তার সবটুকু প্রকাশ পায়নি। গভীরে অনেক রহস্য রয়ে গেছে। পূর্ণ তদন্তের মাধ্যমে এসব বের করে প্রতিবিধান করা জরুরি। কাজটি সরকার আশা করি করবেন।
এখন প্রশ্ন হলো, সরকার কি মনে করেন যে, নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যোগ্য অফিসার হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য যে ট্রেনিং পেয়েছেন, তা যথাযথ ছিল? এই ইউএনও একাত্তর টিভিতে টকশো’তে কথা বলেছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে আছে মন্ত্রির উপস্থিতিতে সাংবাদিকদের সাথে তার উদ্ধত ব্যবহারের ভিডিও। মনে হলো, ‘মব সাইকোলজি রিডিং’ এবং সে অনুযায়ী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা কিংবা নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার বিষয়টি তার উপলদ্ধিতেই নাই। সরকারকে ধন্যবাদ, দেরিতে হলেও রবিবার ইউএনও চৌধুরী মোয়াজ্জাম আহমদকে নাসিরনগর থেকে প্রত্যাহার করেছেন। এখন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হক `হিন্দুদের মালাউনের বাচ্চা’ বলে গালি দেয়ার অভিযোগ কিভাবে মোকাবেলা করবেন সেটিই দেখার বিষয়। এর আগে হজ্জ্ব নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য দেয়ায় মন্ত্রি আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে অপসারণের নজির এই সরকারেরই আছে।
এই তাণ্ডবলীলার পেছনে কেউ না কেউ আছে। তারা হতে পারে শাসক দল, অন্যান্য রাজনৈতিক দল, হেফাজত, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বা ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কেউ। সরকারের উচিত সত্যিকারভাবে তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, কোনো বিবেকবান মানুষই সংখ্যালঘু অন্য ধর্মের কারও উপর এরকম করতে পারে না। যারা করে তারা ফায়দা লোটার দল। যে কোনো উছিলায় দুর্বৃত্তপনার সুযোগ পেলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার সাথে যুক্ত হয় সাম্প্রদায়িক শক্তি। ইসলাম শান্তির ধর্ম, এসব প্রশ্রয় দেয় না।
রামু’র ঘটনার ক্ষেত্রে সরকার যা করেছে, এক্ষেত্রেও সেরকম উদ্যোগ আশা করি। যেমন সরকার অবিলম্বে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি ও মন্দির মেরামত এবং বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেবেন। পাশাপাশি সংখ্যালঘু হিন্দুদের জন্য স্থায়ী নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন। এছাড়াও চিহ্নিত আক্রমণকারীদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা ও তাদের সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে সেই টাকা দৃষ্টান্ত হিসাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা যায় কিনা সেই উপায় ভাবতে পারেন। এটা না করলে দুর্বৃত্তরা ভয় পাবে না। তারা ভাবতে পারে-এসব তাণ্ডব করেও পার পাওয়া যায়। সরকার তো আছেই, সংখ্যালঘুদের ক্ষতিপূরণ দিবে। তাদের এই ধারণা ভেঙে দিতে হবে। হামলাকারীরা এ ধরনের ঘটনা ঘটালে; সরকার আক্রান্তদের শুধু ক্ষতিপূরণই দিবে না, হামলাকারীদের কাছ থেকেও আদায় করা হবে। এরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করা গেলে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রবণতা কমে আসবে।
আমাদের সবার ভাল থাকার জন্যই সমাজকে অসাম্প্রদায়িক করে তুলতে হবে। এটা করতে সময় লাগবে, তবে সম্ভব। সামাজিক প্রতিরোধই এই নীচতার বিরুদ্ধে স্থায়ী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এজন্য ব্যক্তি, স্থানীয় মুরুব্বি, সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, মূল্যবোধ, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, স্কুল শিক্ষক, মিডিয়াসহ সকলের সহযোগিতা দরকার। সবার কাছে অনুরোধ ভবিষ্যত কেউ যদি এরকম পরিস্থিতিতে পড়েন, খেয়াল রাখবেন কান কিন্তু কানের জায়গাতেই আছে, অযথা দৌড়াবেন না। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তির সাম্প্রতিক প্রবণতা হল গুজবের শক্তিকে সংগঠিতভাবে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা-ভাঙচুর করা। সবাই সচেতন থাকলে এটা রোধ করা সম্ভব।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)