চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

গান সিনেমায় জন হেনরি

হেনরির যে বীরগাঁথা, সে তুলনায় তাঁকে নিয়ে প্রসিদ্ধ কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত হয় নি এখনো…

শ্রমিকের রক্তে রাঙানো মহান ‘মে দিবস’-কে নিয়ে বিশ্বের সব ভাষায়, সব দেশে লেখা হয়েছে প্রচুর গল্প, কবিতা উপন্যাস। সংগীতশিল্পীরা গেয়েছেন প্রচুর গান। বাংলা ভাষায় শ্রমিকদের নিয়ে কোনো গানের কথা আসলেই সবার আগে ভেসে উঠে ‘জন হেনরি’। সত্যি বলতে, দেশে দেশে হেনরির জয়গাঁথা নিয়ে সবচেয়ে বেশি রচিত হয়েছে গান!

গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথা ও সুরে বাংলা ভাষায় ‘জন হেনরি’ নামের আমেরিকান এক মহান শ্রমিকের কথা। যে হেনরি মালিকের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে নিজের শ্রম আর ঘামে শ্রমিকশ্রেণির মাথা চির উন্নত করে গেছেন! পৃথিবীর শ্রমিকেরা যার জন্যে এখনো বুক চিতিয়ে বলতে পারেন ‘নাম তার ছিলো জন হেনরি, ছিলো যেনো জীবন্ত ইঞ্জিন’।

শ্রমিক দিবসের সবচেয়ে ছুঁয়ে যাওয়া অথচ অনুপ্রেরণামূলক গানগুলোর মধ্যে হেনরিকে নিয়ে করা গানটিই প্রসিদ্ধ। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পর বাংলা ভাষায় আরো অনেকেই এই গানটি করেছেন। ফকির আলমগীর গানটিতে নতুন সুর সংযোজন করেছেন। জন হেনরিকে নিয়ে করা গানটির প্রতিটি শব্দ শ্রোতার গায়ে কাটা দিবে, কখনো আবেগ আষ্টেপিষ্টে ধরবে, আবার কখনো এক অবিসম্ভাবি দ্রোহ শরীরের রক্ত কণিকায় প্রবাহিত হবে। একটি গানের মধ্য দিয়ে পুরো শতাব্দীকে কতো চমৎকারভাবে তুলে ধরা যায়, তার প্রমাণ ‘নাম তার ছিলো জন হেনরি’।

জন হেনরি কে ছিলেন? আমেরিকার একজন কালো শ্রমিক। ‘কালো শ্রমিক’ এজন্য বলা, তখন সাদা কালোর দ্বন্দ্ব ছিলো চরমে! তো কালো শ্রমিক জন হেনরির একমাত্র সম্বল ছিলো হাতুড়ি। আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার রেলে সুরঙ্গে যিনি পাথরের পাহার কেটে কেটে রেল লাইন তৈরি করেন। কিন্তু মালিকশ্রেণি মানুষ দিয়ে নয়, তারা আধুনিক মেশিন দিয়ে পাহার কাটতে চায়। বাধা হয়ে দাঁড়ান হেনরি। তিনি জানতেন, মালিকশ্রেণি যদি মেশিন ব্যবহার করে পাহার কাটে, তাহলে হাজার হাজার শ্রমিকের কপালে খাবার জুটবে না, না খেয়ে মরতে হবে তাদের। সকল শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে তিনি ঠেলে দিতে পারেন না, তাছাড়া তিনি নিজে একজন শ্রমিক নেতা!

ফলে হেনরি মেশিনের প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে ওঠেন। মালিকদের বলেন, মেশিনের চেয়ে মানুষই সেরা। মানুষকে কখনো কোনো মেশিন পরাজিত করতে পারে না। হেনরির এমন কথা শুনে সাদা মালিক হাসে! অতঃপর মেশিনের সাথে শুরু হয় হেনরির প্রতিযোগিতা। হেনরি জানেন, তাকে মেশিনকে পরাজিত করতেই হবে। তারউপর নির্ভর করছে শতো শতো শ্রমিকের ভাগ্য, শ্রমিকরাও ভয়ে আছেন, আশঙ্কায় আছেন হেনরিকে নিয়ে। রাত যায়, দিন যায় পশ্চিম ভার্জিনিয়ার সেই রেল সুরঙ্গে শুধু হাতুড়ির খট্ খট্ শব্দ শোনা যায়। নীরবে এসে সেই সুরঙ্গে শব্দ শুনে হেনরির স্ত্রী মেরি ম্যাক ডেলিন। প্রতিযোগিতার সময় ফুরিয়ে আসে। মেশিনের সাথে পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ দেহি হেনরিও কাজ করতে থাকেন। তিনি জানেন, মেশিনকে তাকে পরাজিত করতেই হবে। শেষ পর্যন্ত তাই হয়, মানুষের তৈরি স্ট্রিম ড্রিল মানুষের কাছেই পরাভূত হয়। জয় হয় জন হেনরির। আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়েন পশ্চিম ভার্জেনিয়ার হাজারো শ্রমিক। তাকে জড়িয়ে ধরতে যায়, কিন্তু ততক্ষণে আর পৃথিবীতে নেই মেশিনকে পরাভূত করা শ্রমিক জন হেনরি!

তৈরি হয় এক হৃদয় বিদারক ঘটনার। শুধু মৃত্যুর আগে নিজের শ্রমে আর ঘামে তিনি মেহনতি মানুষের জয় নিশ্চিত করে এক ফালি হাসি দেন শ্রমিকের উদ্দেশ্যে। জয় হয় মেহনতি মানুষের, জয় হয় শ্রমিকের। আর দিনকে দিন কালো শ্রমিক জন হেনরির কথা পৃথিবীর কোণায় কোণায় ছড়িয়ে যেতে থাকে। যেনো সত্যি সত্যিই হেনরির বীর গাঁথা বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে সিটি দিয়ে চলে যায় ইঞ্জিন…!

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কণ্ঠে ‘নাম তার ছিলো জন হেনরি’ গানটি:

হেনরিকে নিয়ে চলচ্চিত্র:
হেনরির যে বীরগাঁথা, সে তুলনায় তাঁকে নিয়ে প্রসিদ্ধ কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত হয় নি এখনো। ১৯৯৫ সালে ‘টল টেল’ নামের একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবিতে তার চরিত্র কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হলেও, তা ছিলো যথেষ্ট হতাশ করার মতো। অন্তত সমালোচকদের দৃষ্টিতে। তবে ২০১৮ সালের শেষ দিকে এসে নেটফ্লিক্স ঘোষণা দিয়েছিলো যে, আমেরিকার সেই ফোক লিজেন্ড জন হেনরিকে নিয়ে তারা সিনেমা নির্মাণ করতে যাচ্ছে। ছবির নাম ঠিক করা হয়েছিলো ‘জন হেনরি এন্ড দ্য স্টেটসম্যান’। ছবিতে জন হেনরির চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিলো ডুয়াইন জনসনের। কিন্তু পরবর্তীতে অজ্ঞাত কারণে ছবিটি নিয়ে আর কিছু শোনা যায়নি।

২০০০ সালে বিশ্বখ্যাত ডিজনি ‘জন হেনরি’ নামক একটি কার্টুন চলচিত্র নির্মাণ করে। চলচ্চিত্রটি ২০০০ সালে গিফোনি চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করে। ১৯৭৩ সালে লিক বোসটো এবং ডেভিড অ্যাডামস প্যারামাউন্ট পিকচারের জন্য একটি ১১ মিনিটের চলচ্চিত্র ‘জন হেনরির কিংবদন্তি’ নির্মাণ করেন। ১৯৭৪ সালে এটি অ্যাকাডেমিক পুরস্কার (অস্কার) এর জন্য মনোনিত হয়।