চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

গানে গানে প্রিয়দর্শিনী ববিতা

৩০ জুলাই ছিল বাংলা সিনেমার সোনালী যুগের জনপ্রিয় নায়িকা ববিতার জন্মদিন। যে প্রজন্মের হাত ধরে আমাদের চলচিত্র পূর্ণতা লাভ করে সেই প্রজন্মের অন্যতম একজন তিনি। পূর্ণিমা সেন গুপ্ত, সুলতানা জামান, কবরী, শবনম, সুজাতা, সুচন্দার ধারাবাহিকতায় ষাট দশকের শেষলগ্নে তাঁরও রূপালি জগতে আগমন ঘটে। এরপর দীর্ঘদিন প্রথম সারির জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে তিনি সমাদৃত হন। অতীত-বর্তমানের ধারায় ববিতার জনপ্রিয়তা এখনও বহমান। তাঁর জাদুকরি অভিনয় এখনও মুগ্ধতা ছড়ায়।

তাঁর অভিনীত বেশিরভাগ ছবিই হয়েছে ব্যবসা সফল। কোনো কোনো ছবি ধ্রুুপদও হয়েছে। ববিতা অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে -স্বরলিপি, বাদী থেকে বেগম, পিচ ঢালা পথ, আবার তোরা মানুষ হ, এখনই সময়, আলোর মিছিল, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, ভালো মানুষ, জন্ম থেকে জ্বলছি, অশনি সংকেত, সোনা বউ, বসুন্ধরা, ফেরারি বসন্ত, আনারকলি, লাইল মজনু, লাঠিয়াল, পেনশন, দহন, এক মুঠো ভাত, অনন্ত প্রেম, নিশান, কসাই, সূর্যগ্রহণ, বন্দিনী, রামের সুমতি, পোকামাকড়ের ঘরবসতি, সোহাগসহ আরও অনেক ছবি।

অভিনয়ে আসার পর রোমান্টিক, ফ্যান্টাসি, গ্রামের প্রতিবাদী চরিত্র-সবখানেই নিজেকে অনিবার্য করে তোলেন তিনি। আর তাই সত্তর ও আশির দশকে বাঙালি মননে-হ্নদয়ে অন্যরকম এক উষ্ণতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন এই প্রিয় নায়িকা। পুরনো ছবির ঝাঁপি খুললেই ববিতাকে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রায় সব ধরনের চরিত্রেই তিনি অভিনয় করেছেন। গ্রামের তরুণী থেকে শহরের মধ্যবিত্ত হয়ে আধুনিকা। সবখানেই নিজেকে মেলে ধরেছেন অপূর্ব অভিনয় গুণে। তবে ফ্যাশন স্টেটমেন্টে ববিতা সবার উপরেই ছিলেন। সব পোশাকে তাঁকে মানানসই মনে হয়েছে। কামিজ, শাড়ি থেকে, শার্ট-প্যান্ট আর মাথায় বড় হ্যাট ববিতার মতো কাউকে অত আকর্ষণীয়া মনে হয়নি। ‘ববিতা কাট’ ব্লাউজ এখনও ট্রেডমার্ক। ববিতার মিষ্টি হাসি, এলো চুল, চোখের মিষ্টি চাহনি-ছিল বরাবরই বাড়তি শোভা।

চলচিত্রে ববিতার লিপের গানগুলোও সবসময় হয়েছে প্রাণবন্ত। স্যাড, রোমান্টিক, স্যাটায়ার সবগানের লিপেই তিনি নিজেকে উজাড় করে দিতেন। তিনি অনেক গানে এমনভাবে লিপ দিয়েছেন মনে হয়েছে একেবারেই সত্য, তিনিই গাইছেন। তাইতো আড়ালের শিল্পীর নামের কথা পর্যন্ত ভুলে গেছেন দর্শকরা। তাঁর লিপের অনেক গান আমাদের চোখের সামনে ভাসে। দুঃখ, হাসি-কান্না, রোমান্টিক, অভিমান- কত না ধরনের গানে তিনি লিপ দিয়েছেন। অনেক পরিচালক বলেছেন প্রতিটি গানের লিপের ক্ষেত্রে অত্যন্ত যত্নশীল থাকতেন ববিতা। গানের কথা ও সুরের উপর শতভাগ এক্সপ্রেশন দিয়ে গানের চিত্রায়ন ফুটিয়ে তুলতে নিবিষ্ট থাকতেন। ববিতা স্বকণ্ঠে কখনও গান গেয়েছেন বলে শুনিনি। কিন্তু চলচিত্রে তাঁর প্রতিটি গানের ভাবের গভীরে প্রকাশ এবং নিজেকে একাত্ম করে ফেলার প্রশংসা করতেই হবে। তাঁর লিপের কিছু গান এখনও দেখলে সিনেমা প্রেমিকরা অন্যরকম হয়ে যান। প্রতিটি গানকে প্রাণবন্ত ও জীবন্ত করতে কথা ও সুরের সাথে অভিনয় করেছেন শতভাগ।

শুরুটা ছিল বোধ হয় নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘স্বরলিপি’ ছবি দিয়েই। এই ছবিতে সুবল দাসের সুরে তাঁর লিপে ছিলো রুনা লায়লার কণ্ঠে ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি’ গানটি। ধনীর কন্যা পিয়ানো বাজিয়ে গানটি গাইছেন। ববিতা তখন চপলা কিশোরী। কেশবিন্যাশ আর ডাগর চোখে অপরুপ এক প্রিয়দর্শিনী। এরপর আরো কত গান! ১৯৭০ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘পিচ ঢালা পথ’ ছবিতে যেনো দর্শকদের আরও মাত করলেন। কাজলে আঁকা ডাগর চোখে আধুনিকা ববিতা সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গাওয়া ‘এই উত্তলা রাতে কেন যে শুধু জাগে থাকে মন’, এবং শাহনাজ রহমত উল্লাহের গাওয়া ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে চুপি চুপি দোলা দেয়’-এই দুটি গানে সেই মনোমুগ্ধকর লিপসিং চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

নায়ক রাজ্জাকের সাথে প্রেম আর রোমান্টিকতার রসায়নে দৃশায়িত গান দুটি যুগ-যুগান্তর জয় করে আছে। এরপর খান আতা পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিতে যেনো তিনি অন্যরুপে উদ্ভাসিত হন। এই ছবিতে আবিদা সুলতানার গাওয়া ‘তুমি চেয়েছিলে ওগো জানতে’ গানটি প্রতিটি কথার সাথে চোখের অর্পূর্ব চাহনীতে লিপ মিলিয়ে অসম্ভব রোমান্টিকতায় ফুটিয়ে তোলেন। আর পরিচালক আমজাদ হোসেন আরও বাজিমাত করেন ‘সুন্দরী’ ছবিতে। ববিতার লিপে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘আমি আছি থাকবো’ গানটি অমরত্ম লাভ করে।

চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ভালো মানুষ’ ছবিতে সুবল দাসের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘যে কথা নীরবে ভাষা খুুঁজে, বুকে আমার সারাক্ষণ’- পাহাড় আর সমুদ্রের কোলে অপরুপ রোমান্টিকতায় তুলে ধরেন নায়ক বুলবুলের সাথে। সাইফুল আজম কাশেম পরিচালিত ‘সোহাগ’ ছবিতে নায়ক রাজ্জাকের সাথে লিপ করেছিলেন আলী হোসেনের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া গান ‘আমি সাজবো নতুন সাজেরে, তাই মন খুশিতে নাচেরে’। গানটিতে অসম্ভব অভিনয় দক্ষতা দিয়ে অন্যরকম স্নিগ্ধতা তুলে ধরেছিলেন।

রোমান্টিক গানগুলোতে নাচ এবং অভিনয় দুটোতেই ববিতা বরাবরই অনবদ্য থেকেছেন। ৭২ সালে মুক্তি লাভ করে মোস্তফা মেহমুদ পরিচালিত ‘মানুষের মন’ ছবি। এই ছবিতে সাবিনা ইয়াসমিন ও মোহাম্মদ আলীর যুগল কণ্ঠে গাওয়া রোমান্টিক গান ‘আমি কতদিন কতরাত’ নায়ক রাজ্জাকের সাথে লিপ করতে হয় তাঁকে। আউটডোর লোকেশনে অসম্ভব প্রেমময় করে তোলেন। প্রতিটি কথার সাথে নিজের সবকিছু উজাড় করে দেন। রাজ্জাক পরিচালিত ‘অনন্ত প্রেম’ ছবিতে খুরশিদ আলম ও সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে আজাদ রহমানের অপূর্ব সুরের গান ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি’ এক অন্যরকম প্রেমময় ববিতাকে দেখতে পাওয়া যায়।

দারাশিকো পরিচালিত ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে রুনা লায়লা এবং জাফর ইকবালের কণ্ঠে আজও এক বিস্ময় নিয়ে আছে ‘প্রেমের আগুনে প্রেমের আগুনে’ গানটি। কিন্তু এই গানটি ববিতার লিপে অনন্যতা লাভ করে। আর তাই এখনও গানটি মানুষের হ্নদয় জয় করে আছে। একইভাবে ইবনে মিজান পরিচালিত ‘নিশান’ ছবিতে রুনা লায়লার কণ্ঠে ‘চুপি চুপি বলো কেউ জেনে যাবে’ গানটিতে জাভেদের সাথে ববিতার যে হ্নদয়কথন তাতো অবিনশ্বর।

ইবনে মিজান পরিচালিত ‘আনারকলি’ ছবিতে সত্য সাহার সুরে রুনা লায়লার কণ্ঠে গাওয়া ‘আমার মন বলে তুমি আসবে’ গানটিতে ববিতা মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। এই একটি গান দেখতে সেসময় অনেক দর্শক ‘আনারকলি’ ছবি একাধিকবার দেখেন। একইভাবে ‘আলিফ লায়লা’ ছবিতে ‘লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া, মজনুগো আঁখি খোলো’-গানটির লিপে ববিতা যেনো নিজেই ভেসে গিয়েছিলেন। মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘সমর্পণ’ ছবিতে খোন্দকার নূরুল আলমের সুরে নার্গিস পারভীনের কণ্ঠে ‘তারাদের সকল আলো জ্বললো আমার বুকে এসে’ গানটি ববিতা নিজের লিপে অসাধারণভাবে তুলে ধরেন। এই গানটির প্রতিটি দৃশ্যে তিনি নায়ক রাজ্জাকের সাথে রোমান্স, সংকোচ, স্বপ্নের অসম্ভব অনুরণন তুলেন। শেষদিকে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত অবুজ হ্নদয় ছবিতে রুনা লায়লার গাওয়া ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’ গানে জাফর ইকবালের সাথে লিপ করে দর্শক হ্নদয় জয় করেন।

খান আতা পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিতে শাহনাজ রহমত উল্লাহের কণ্ঠে গাওয়া ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’ গানটি পরিবেশন করেন বঙ্গবাণী মহাবিদ্যালয়ের বিচিত্রানুষ্ঠানে। সামনে বসা মুক্তিযুদ্ধ ফেরত প্রতিবাদী তরুণরা। স্টেজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করছেন ববিতা। আব্দুল্লাহ আল মামুন পরিচালিক ‘এখনই সময়’ আবিদা সুলতানা গেয়েছিলেন ‘একটি দোলনা যদি কাছে পেতাম’। ববিতার আবেগ আর স্বপ্নের মাখামাখি ছিল। আমজাদ হোসেন পরিচালিত সুন্দরী ছবিতে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘কী করে বলিব আমি গানটি এখনও’ ববিতার দুঃখ, ক্রোধ, অভিমানে ভরা।

আওকাত হোসেন পরিচালিত সাক্ষী ছবিতে আনোয়ার পারভেজের সুরে শাহনাজ রহমত উল্লাহর কণ্ঠে ‘ পারিনা ভুলে যেতে, স্মৃতিরা মালা গাঁথে’, এই গানটিতে ববিতা গাড়ি চালাচ্ছেন। লিপসিং করতে হয়নি। গাড়ির ক্যাসেটে গান বাজচ্ছে। গাড়ি ড্রাইভ করছেন ববিতা। কিন্তু গানের সাথে দুঃখ আর অভিমানের এক নিদারুণ অপরুপতা তুলে ধরেন। মোশতাক পরিচালিত বন্দিনী ছবিতে আনোয়ার পারভেজের সুরে রুনা লায়লার কণ্ঠে ‘গান নয় জীবন কাহিনী’ এবং ‘ইশারায় শীষ দিয়ে আমাকে ডেকনা’ এ দুটি গানে অসম্ভব মমতায় নিজের তুুলে ধরেন। ১৯৮০ সালে আব্দুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘এখনই সময়’ ছবিতে শেখ সাদীর সুরে ‘জীবন মানে যন্ত্রণা নয় ফুলের বিছানা’, মিতা পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’ ছবিতে সত্য সাহার সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া এই পৃথিবীর পরে, কত ফুল ফোটে আর ঝরে’ অতুলনীয়ভাবে তিনি লিপ করেন।

আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘নয়নমণি’, ‘সুন্দরী’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’সহ অন্যান্য ছবিতে আলাউদ্দিন আলীর সুরে একাধিক গানে লিপ করেন ববিতা। ‘নয়নমণি’ ছবিতে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘নানী গো নানী’ গানটিতে তিনি অসাধারণ লিপ করে সেসময় গ্রামেগঞ্জের মানুষের মুখে তুলে দিয়েছিলেন গানটি। ‘সুন্দরী’ ছবিতে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘তোমারও দুনিয়া, দেখিয়া শুনিয়া’-এই গানে অন্যরকম এক ববিতাকে দেখেছিল দর্শকরা। একইভাবে আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ ছবিতে ‘দুঃখ ভালবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়’ এবং ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’ এই দুটি গানে যেনো জীবনের সব মমতা ঢেলে দিয়ে লিপ করেছিলেন। দুটি গানেই তিনি মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। ববিতার লিপে এরকম আরো অনেক গান রয়েছে। তাঁর প্রাণবন্ত অভিনয়ে যে গানগুলো কালজয়ী হয়ে আছে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)