ক’দিন ধরেই একটু একটু পরিবর্তন আসছে চারপাশে। মনে হচ্ছে অনেক দিন পর স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছে গাছপালা। কেমন যেন এক অস্থিরতা কাজ করছে গাছের শরীরে। যেন কাছে গিয়ে হাত রাখলেই বলে উঠবে সেও, আবার আমিও বেঁচে উঠবো।
দুপুরটাও লম্বা হয়েছে ঢের। বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম রোদ পোহানোর আশায়। আর বোঝার চেষ্টা করছিলাম চোখের সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ভাষা। পুবালি বাতাসে যখন রোদের আঁচ খুঁজছিলাম ঠিক তখনই দক্ষিণা এক উটকো হাওয়া এসে সব এলোমেলো করে দিলো। মুহূর্তে ফিরে গেলাম কমপক্ষে কুড়ি বছর আগে। সিনেমার ফ্যাশব্যাকও অতোটা স্পষ্ট নয় যতটা স্পষ্ট হয়ে সামনে দাঁড়ালো প্রিয় শৈশব-কৈশোর। স্কুল ছুটির দিনে দুপুরটা ঘুমের জন্যই বরাদ্দ থাকতো। নতুন আলু, ফুলকপি, মটরশুঁটি, টমেটো দিয়ে রান্না মাছের ঝেলে গরম ভাত খেয়ে সোজা বিছানা। এই সময়টাতে আমরা লেপ ছেড়ে আবার কাঁথায় ফিরতাম। আমাদের বেশীর ভাগ কাঁথাই বোনা হতো মার পুরনো শাড়ি দিয়ে। তাই পুরো শরীর জুড়ে একটা মা মা গন্ধ লেগে থাকতো। যেই চোখদুটো একটু লেগে আসতো ঠিক তখনই হাঁক ছাড়তো ফেরিওয়ালা। সে সময়টা ফেরিওয়ালার উৎপাত ছিলও বেশ।
লেইস ফিতা থেকে শুরু করে পুরনো বইখাতা অথবা ভাঙা কাঁচ দিয়ে কটকটি পর্যন্ত। নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় প্রায় সবই পাওয়া যেতো ফেরিওয়ালার কাছে। তারা পণ্যের গুনগত মান নিশ্চিত করতে সবই জানাতেন। শুধু জানাননি বহু বছর পর জমিয়ে রাখা সেসব ভাঙা কাঁচের জন্য মন ভেঙে যাবে পুরনোয়। সে যাক, মন ভাঙার গল্প না হয় আরেক দিন করা যাবে। সেসময়ের দুপুরে চিঠিও আসতো খুব। আলসে দুপুরে যতই ঘুম পাক না কেন কান ঠিক ঠিক চিনে নিতো ডাকপিয়নের কড়া নাড়া।
আর আমাদের পাড়ার ডাকপিয়ন ছিলেন একেবারেই নাটকের ডাকপিয়নের মতো। কাঁচাপাকা চুল, খাকি পোশাক ও কম কথা বলা মানুষ। আমার কোন চিঠি আসবে না জেনেও দৌড়ে যেতাম। এ অভ্যাসটা লম্বা হয়েছিলো টিএন্ডটি’র ল্যান্ড ফোন পর্যন্ত। চিঠিটা কোনোমতে হাত গুঁজে দিয়েই বিদায় নিতেন ডাকপিয়ন।
কতদিন ভেবেছি আমি ডাকপিয়নের পিছু পিছু চলে যাবো দূরে কোথাও। তবে কেন এমন মনে হতো আজো বুঝি নাই তা। দক্ষিণা হাওয়া ছেড়ে দেয়ায় ব্যাডমিন্টনের পাঠ চুকে যেতো এ সময়টাতে। পায়ের পাতার আগায় ফুটবলের ছোঁয়া পেয়ে চাবুকের মতো হাওয়া কেটে ছুটতো শরীর। জুলফি বেয়ে দরদর নেমে আসা ঘাম বলে দিতো এ যাত্রায় শীতের বিদায় হয়েছে। সন্ধ্যায় মসজিদের কলে মুখ লাগিয়ে পানি পানই বুঝিয়ে দিতো শীতের বিদায়।
সে সময়তে তো আর বিশুদ্ধ পানি বলে কিছু ছিলো না, আমরা যে কোন কল থেকেই পানি খেতে পারতাম। বিদায় সব সময় বেদনার হলেও শীতের বিদায় ছিলো মধুময়। শুকনো ঠোঁট আর তেলচিটচিটে চুল থেকে মুক্তির সময় ছিলো এটা। ধুলোর শহরে গাছের পাতা ধুয়ে মুছে আবার সজীব হয়ে ওঠার সময় ছিলো এটা। কোকিলের একটানা ডাকে ২০১৮ তে ফিরি অবশেষে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি বিকেল হৈ হৈ করছে। চোখ মেলে ভালোভাবে দেখি কোথাও বড় কোন পরিবর্তন নেই। খুব ধীর পায়ে পায়ে আসছে ফাগুন। দু একটা কোকিলের ডাক এখন চাপা পড়ে যায় গাড়ীর হর্নে।
পাতা ফাঁকে উকি দেয়া সবুজ পাতা মাথা নিচু করে রাখে ধুলো আর ধোঁয়ায়। হটাৎ ছাড়া ফাল্গুনী বাউ আটকে পড়ে ভারী কাঁচের ওপাড়ে। স্মার্টফোন আর ক্যাবল টিভির টানে পালিয়ে যায় প্রিয় ভাতঘুম। খুব গোপনে প্রেমিকের মনে হালকা করে কড়া নাড়ে বসন্ত। প্রেমিক চমকে ওঠে মিল খুঁজে পায় ২০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া লেইস ফিতাওয়ালার সাথে। আধোঘুমে জাগরণে দূর থেকে ভেসে আসা ফেরিওয়ালার সেই ডাকের মতো আমার ঢাকায় এখনো আসে বসন্ত। কখনো চেনা যায় আবার কখনো লাগে অচেনা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)