অন্যরকম এক মা তিনি। গর্ভে ধারণ না করেও যে একজন নারী স্নেহময়ী-মমতাময়ী মা হতে পারেন তার প্রমাণ সাবেরা খাতুন। ৪৬ বছর বয়সে হয়েছেন ১৪ সন্তানের জননী। সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করছেন সমাজে। মমতাময়ী এই মাকে দেখলে যে কারোরই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যাবে।
এমন মায়ের দেখা মেলে এসওএস শিশুপল্লীতে। শুধু সাবেরা খাতুনই নয়; তার মতো অনেক মা শিশু পল্লীতে হাসিমাখা মুখ স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলেছেন অসংখ্য এতিম শিশুকে।
সাবেরা খাতুনের সবচেয়ে বড় সন্তানের নাম রিতা আক্তার বর্তমানে লালমাটিয়া কলেজে অধ্যয়নতর। সবচেয়ে ছোট সন্তানের নাম নুসতাদ জাহান রোজা। বয়স ১ বছর ১০ মাস। প্রতিটি সন্তানই সমান প্রিয় এ মায়ের কাছে। সব বয়সী সন্তান রয়েছে তার। রাত-দিন অবিরাম পরিশ্রম করে চলেছেন সন্তানদের জন্য। এই সন্তানদের খাওয়ানো, গোসল করোনো, পড়ানো সব দায়িত্ব এই মায়ের। ব্যস্ততার মাঝেই তিনি খুঁজে পান শান্তি ।
তবে জীবনে চলার পথ ততোটা সহজ ছিল না এ মায়ের। ২০০০ সালে বসেন বিয়ের পিঁড়িতে। ভাগ্যবিধাতা এ বিষয়ে খুব বেশি প্রসন্ন হননি তার ওপর। মাত্র তিন মাসের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে স্বামীর সঙ্গে। এরপর যেয়ে ওঠেন বাবা-মায়ের সংসারে। ৭ জনের সংসারে নিজেকে মনে হতে থাকে এক বাড়তি বোঝা। আর তাই তখন থেকেই খুঁজতে থাকেন এমন একটা চাকুরি যেখানে অনেক ছোট ছোট শিশুদের সাহচর্যে থাকতে পারবেন। নিজের অতীতটাকে ভুলতে সারাদিন ব্যস্ত থাকার এক ছুতো খুঁজছিলেন এ নারী। এরই মাঝে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকে চাকুরি নেন শিক্ষক হিসেবে।
এভাবে ৪ বছর অতিবাহিত হবার পর ২০০৫ সালের ২২ জুলাই এসওএস শিশুপল্লীতে নিয়োগ পান। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল জানতে চাইলে এই মা হারিয়ে যান সুদুর অতীতে। ‘প্রথম দিন একসঙ্গে এতগুলো শিশু দেখে অনেক আনন্দিত হয়েছিলাম, বারবার মনে হচ্ছিল আমার চাওয়ার সঙ্গে পাওয়াটা একদম মিলে গেছে।’
এতগুলো বাচ্চাকে একসঙ্গে সামলাতে যেয়ে প্রায়শই হিমশিম খেতে হয়েছে তাকে। এরপরও হারাননি মনোবল। ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পরিশ্রম করে চলেছেন সন্তানদের জন্য। এত পরিশ্রমের পরও কখনো বিরক্তি আসেনি তার এ কাজে। সন্তানরা অসুস্থ্য হলে রাতের পর রাত জেগে দিয়েছেন সেবা। সন্তানদের জন্য নীরবে ফেলেছেন চোখের জল।
এসওএস শিশু পল্লীর যে বাড়িতে সাবেরা খাতুন তার সন্তানদের নিয়ে থাকেন সে বাড়িটির নাম সোনালি। ডুপ্লেক্স বাড়িটির সর্বত্র যত্নের ছাপ সুস্পষ্ট। সাজানো গোছানো বাড়িটিকে দেখলেই বোঝা যায় বাড়িটির প্রতিটি কোণায় রয়েছে এক স্নেহময়ী মায়ের হাতের স্পর্শ। তার সন্তানদেরও দেখা যায় সবসময় তাকে ঘিরে থাকতে। মাও তার উষ্ণ ভালবাসায় জড়িয়ে রাখেন সন্তানদের।
‘তার মেজ মেয়ে তাহসিনা তাবাসসুম বলেন, মা’কে নিয়ে আমার যে অনুভূতি তা বলে বোঝাতে পারব না। ছোট থেকে এত বড় হয়েছি কখনোই মনে হয়নি এটা আমার নিজের ‘মা’ না। আমার মা কখনও আমাদের কোন কিছুর অভাব বোধ হতে দেননি। চাওয়ার অাগেই আমাদের সব অভাব পূরণ করেছেন। মা তার নিজের জমানো টাকা থেকে সবসময় আমাদের শখ পূরণ করে আসছেন।’
এই মায়ের আরেক সন্তান সুমী বলেন, ‘আমার মা’কে আমার খুব ভাল লাগে। মা কে ছেড়ে কোথাও গেলে মনটা অস্থির হয়ে যায় বারবার মনের হতে থাকে কখন ফিরবো আমার স্নেহময়ী মায়ের কোলে।’
সন্তানরা যেমন ভালবাসে তাদের মা’কে। মা’ও তেমনি ভালবাসেন তার সন্তানদের। প্রতিবছর ২২ দিনের একটি ছুটি পেয়ে থাকেন সাবেরা খাতুন। কিন্তু এই ২২ দিনের মধ্যে ৭ দিনও তার নিজের বাড়ি নওগাঁয় যেয়ে থাকতে পারেন না। সন্তানদের ছেড়ে থাকার কথা বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন এই মা। কিছুদিন আগে ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলেন সেসময় মুঠোফোনে তার ছোট সন্তান রোজার কান্না আর আধো আধো বোলে মা মা বলে ডাক এখনও কাদাঁয় তাকে।
‘২২ দিনের ছুটিতে যেয়ে ৭ দিন থেকেই আবার ফিরে আসি। বাচ্চাদের জন্য মনটা খুব খারাপ লাগত। বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই কান্না চলে আসত। বড় বোনের কথামত ফিরে আসি। যখন আমি ফিরে আসি তখন আমার নয়নের মণি আমার রোজা এমনভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে আর ওর মাথাটা এমনভাবে আমার বুকে রাখে যেন ও স্বর্গ হাতে পেয়েছে। আর আমিও আমার স্বর্গ হাতে পেয়েছি।’
রোজার জড়িয়ে ধরার মাঝে যে আকুতি ছিল তা মনে হলে এখনও আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন এই মা।
সন্তানদের ভালবাসাকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে অভিহিত করেন তিনি। আর এখানেই তার সার্থকতা খুঁজে পান।
এসওএস শিশুপল্লী একটি আন্তর্জাতিক শিশু কল্যাণ সংস্থা। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে এর কার্যক্রম শুরু হয়। এ সংস্থার মাধ্যমে বর্তমানে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, চট্টগ্রাম, বগুড়া কেন্দ্রে প্রায় ৯ শতাধিক শিশু প্রতিপালিত হচ্ছে।