চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিতে রোহিঙ্গা নারীরা আগ্রহী নয়

গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিতে রোহিঙ্গা নারীরা এখনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে আগ্রহী নয়। এর পেছনে সামাজিক কু-শিক্ষা, ধর্মীয় অনুভূতির অন্তরালে পারিবারিকভাবে মেনে আসা সনাতনী পদ্ধতিসহ বেশকিছু কারণ দায়ী। গর্ভ ও প্রসবকালীন সময়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র বিমুখিতার কারণে রোহিঙ্গা নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ব্র্যাক স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর একদল গবেষকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য। এই গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত মে মাসে এই দলটি তাদের গবেষণা কার্যক্রম শুরু করে।

বৃহস্পতিবার কক্সবাজার শহরের একটি হোটেলের সম্মেলন কক্ষে এক সেমিনারে তথ্যগুলো তুলে ধরা হয়। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে বেশকিছু প্রস্তাবনা এবং পরামর্শ দিয়েছে গবেষক দলটি। তাদের প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন হলে গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে সেবা নিতে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হবে বলে প্রত্যাশা তাদের।

‘রোহিঙ্গা নারীদের সনাতনী পদ্ধতিতে যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের ধরণ’ শীর্ষক বিষয়ের উপর গবেষণা কার্যক্রম চালানো হয় উখিয়ার দুটি রোহিঙ্গা শিবিরে। এই গবেষণা কার্যক্রমে দলটি ২৭ জন গর্ভবতী মহিলা এবং প্রসূতি নারীর সাথে দীর্ঘ সাক্ষাতকার গ্রহণ করে। ১৯ জন স্বাস্থ্যকর্মী, যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থার কর্মীদের কাছ থেকেও নেওয়া হয় নানা তথ্য। এছাড়াও গর্ভবতী নারীর স্বামী, প্রসূতি নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ, ইমাম, ক্যাম্পের মাঝি, কমিউনিটি লিডারসহ বিভিন্ন গ্রুপের সাথে কথা বলে মৌলিক সমস্যাগুলো তুলে আনা হয়।

গবেষণা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেয়া ব্র্যাক স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর অধ্যাপক ড. কাউসার আফসানা বলেন, অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ এবং মাতৃত্বকালীন যে সেবা দরকার সেই সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই রোহিঙ্গা নারীদের। এছাড়াও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে গর্ভকালীন ও প্রসবোত্তর সেবা গ্রহণে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়ে গর্ভবতী নারী এবং পরিবার আগ্রহী নয়। আধুনিক চিকিৎসার সুফলের বিষয়ে তাদের ধারণাও অত্যন্ত কম। তারা মনে করে যে, প্রসবকালীন সময়ে হাসপাতালের পরিবর্তে নিজের ঘরেই সন্তান প্রসব করা উচিত। বাসার ‘আঁতুড়ঘরে’ প্রসব করাতে হয়। আঁতুড়ঘরে তারা নানা সেবা পেয়ে থাকে। কিন্তু হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রসব হলে তারা মনে করে এসব সেবা সেখানে পাওয়া যায় না।

তিনি আরও বলেন, গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারীর স্বামীরা মনে করেন যে, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে বা হাসপাতালে প্রসবসেবা নেওয়া ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে উচিত নয়। এছাড়াও সামাজিক পরিবেশও তাদেরকে সমর্থন করে না। এসব কারণে গর্ভকালীন ও প্রসবোত্তর পরিচর্যা সঠিক না পাওয়ায় রোহিঙ্গা মায়েদের স্বাস্থ্য চরম ঝুঁকিতে থাকে।

ড. কাউসার আফসানা বলেন, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে গর্ভবতী ও প্রসূতি নারীদের সেবা গ্রহণে আসার হার একেবারে যে শূন্য তাও নয়। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতেও কিছু কিছু ডেলিভারি হচ্ছে এবং প্রসবোত্তর সেবা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকদের আচরণকে অধিকাংশ রোহিঙ্গা নারী স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না। চিকিৎসকদের আচরণকে তারা ভয় হিসেবে দেখে। এর বিপরীতে তারা বার্মিজ হাতুড়ে চিকিৎসক ও কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নেয়। এর ফলে মায়েদের স্বাস্থ্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে। তাই চিকিৎসদের রোগিবান্ধব আচরণ নিশ্চিত করতে হবে।

রোহিঙ্গা গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে বেশকিছু পরামর্শ গবেষণা পত্রে তুলে ধরা হয়েছে। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করণ এবং পরামর্শসেবা আরও উন্নত করতে হবে। যাতে রোহিঙ্গা নারী এবং পুরুষেরা সহজেই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে আসতে এবং সেবা নিতে আগ্রহী হয়।

ড. কাউসার আফসানা বলেন, সম্মিলিতভাবে কাজ করে গর্ভকালীন ও প্রসবসেবা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে পারলে গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে চিকিৎসা নেওয়ার হার মানসিকতা বৃদ্ধি পাবে।

সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাক স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর অধ্যাপক ড. জাহিদুল কাইয়ুম, গবেষণা কার্যক্রমের ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর নজরানা খালেদ, ড. সাবরিনা ফায়েজ রশিদ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ডায়ান গার্ড ও ডা. সঞ্চয় চন্দ, পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক ডা. পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য্য, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. নোবেল কুমার বড়ুয়া, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের স্বাস্থ্য সমন্বয়ক ডা. আবু মো. তোহা, হোপ ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর জাহিদুজ্জামান প্রমুখ।