প্রতিষ্ঠান কোনো আবেগ বোঝে না। আইন, জবাবদিহিতা ও কাঠামোবদ্ধ শৃংখলার কাছে নেই আবেগের দাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য পদত্যাগী গভর্নর ড. আতিউর রহমান তার সুদীর্ঘ ও কর্মময় জীবনে এই সত্য বুঝতেন না তা নয়। কিন্তু তিনি তার আবেগ ধরে রাখতে পারেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় পদত্যাগের সামান্য আগে সাংবাদিকদের সামনে তার অশ্রুসজল অবয়ব আর সাতটি বছরের স্বপ্নের কর্মময়তা নিয়ে উচ্চারিত বক্তব্য ব্যতিক্রমী এক নজির। ব্যতিক্রম এই জন্য যে, বাংলাদেশে যে কোনো ঘটন-অঘটনে সরকারের বা রাষ্ট্রের পদস্থ কোনো ব্যক্তির পদত্যাগের নজির খুব একটা নেই।
এদেশে এ পর্যন্ত দুর্ঘটনা ও কেলেংকারি কম হয়নি, কিন্তু স্বেচ্ছায় পদত্যাগের সিদ্ধান্তের মধ্যে যে সাহসিকতা; তা এক ধরনের ইতিবাচক চর্চার আভাস দেয়। গভর্নর হিসেবে ড. আতিউরের পদত্যাগের পেছনে গণদাবি ছিলো না। ছিলো নানামুখি প্রচারণা। কেউ কেউ বিষয়টিকে একরকমের মওকা হিসেবে নিয়ে অনির্দিষ্ট পথে তীর ছোঁড়ার মতো নানান মন্তব্য করছেন সামাজিক মাধ্যমে। লিখছেন অনলাইনে। এর মধ্যে কেউ ধুম্রজাল সৃষ্টির সুযোগ খুঁজছেন কি-না কে জানে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ম গভর্নর হিসেবে ড. আতিউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একটি নতুন ধারা সূচিত হয়। অর্থনীতিকে সহজিকরণ ও গণমানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার রয়েছে সুদীর্ঘ গবেষণা। বাংলার উন্নয়ন দর্শনের দুই মহারথী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে তার মনোজগতে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রেখে আসছে তা তার একাধিক গ্রন্থ ও প্রকাশনায় দেখতে পাওয়া যায়।
এর মধ্য দিয়ে আমাদের গ্রাম ও শহরের দারিদ্র, তৃণমূলের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত হয়েছে। এদেশে কৃষকের জন্য ১০ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট থেকে শুরু করে, বর্গা চাষী ঋণ, স্কুল শিক্ষার্থী ও পথশিশুদের ব্যাংকিং ব্যবস্থাও প্রবর্তিত হয়েছে ড. আতিউর রহমানের সময়ে। গ্রাম ও শহরের, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে তার অর্থনৈতিক চিন্তা ছিলো যথেষ্ট সরল ও বোধগম্য পর্যায়ের।
বিগত সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ছিলো মানুষের কাছে অগম্য ও দুর্বোধ্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান যার শুধু ভবনটিই দেখা যেতো। ড. আতিউর রহমানের একের পর এক উদ্যোগের মধ্যে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্তির কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক মানুষের জানাশোনা একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পেরেছে। এই কাজগুলো একজন গভর্নরের কর্মদক্ষতা ও আন্তরিকতারই ফলাফল। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তার ভুলগুলো কি ছিলো, দুর্বলতাই বা কি ছিলো তা ওয়াকেবহাল ও বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় জাতীয় অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কথা উঠেছে, ড. আতিউর একজন ভালো মানুষ, ভালো অর্থনীতিবিদ, ভালো গবেষক হলেও একজন ভালো প্রশাসক ছিলেন না। কেউ কেউ খুঁজতে চাইছেন, ভেতরের অনেক রহস্য। মানুষের প্রশ্নসমষ্টির জড়ো হয়ে সামাজিক মাধ্যমে চলছে নানামুখি প্রচারণা। বিষয়টি যেনো হলমার্ক কেলেংকারি কিংবা স্টক এক্সেচেঞ্জ কেলেংকারির মতো ধুম্রজালের মধ্যে মিলিয়ে না যায়, সে বিষয়টিও গভীরভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। একই সঙ্গে প্রশ্ন থেকে যায়, হলমার্ক কেলেংকারির মতো ইস্যুতে কাউকে পদত্যাগ করতে দেখা যায়নি কেনো!
বর্তমান সরকারের সময়েই দেশের উন্নতির মাপকাঠি হিসেবে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভকে সর্বাগ্রে বিবেচনা করা হয়। বিগত সময়ে এক্ষেত্রে গলাবাড়িয়ে উচ্চারণের মতো সাফল্য আমাদের ছিলো না। টানা কয়েক বছর রিজার্ভের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এর অর্থনৈতিক সাফল্যসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের তথ্য অর্থনৈতিক সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্টরা নিয়মিত পেয়েছেন গভর্নর কার্যালয়ের ইমেইলের মাধ্যমে। এতে উদ্দিষ্ট্য ও সংশ্লিষ্টদের জন্য সুবিধা হলেও দাপ্তরিক কার্যক্রমের তথ্য প্রতিদিন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার কাজটি কতোটা ফলপ্রসু তা ভেবে দেখা উচিৎ হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর পদত্যাগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। এর পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুইজন ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা ও আবুল কাশেমকে অপসারণ করা হয়েছে। একই ইস্যুতে মতিঝিল থানায় একটি মামলাও দায়ের করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবমিলিয়ে সত্য উদঘাটন ও রহস্য উন্মোচনে সরকারি তৎপরতা জোরেশোরেই শুরু হয়েছে। সবার কথা, ‘ছিদ্রটি’ বের হোক, যে ছিদ্রপথে ঘটেছে অর্থ চুরির ঘটনা।
এ ঘটনাটিই শেষ, না কি এর সঙ্গে আরো অনেক কিছু রয়েছে তাও জানার অপেক্ষায় রয়েছে মানুষ। তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশের সঙ্গে বাংলাদেশ একই গতিতে পথ চললেও অপরাধী সনাক্তকরণের বিজ্ঞানচর্চায় আমাদের ব্যর্থতা রয়েছে। দেশে বহু অপরাধ, অঘটন, কেলেংকারি রয়েছে যা যুগ যুগ ধরে কুলকিনারাবিহীন। অপরাধীরা বহু ক্ষেত্রে জাতির চোখে ধুলো দিতে পেরেছে সাফল্যের সঙ্গে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির রহস্য উন্মোচন ও জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটবে না, নিশ্চয়ই এই আশা আজ দেশের প্রতিটি নাগরিকের।
(এ
বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর
সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)