চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘গতিময়’ ফাইনালের অপেক্ষায় চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম থেকে: দুই দলেরই একই মন্ত্র, আক্রমণে ধসিয়ে দাও প্রতিপক্ষের রক্ষণ। দুদলই খেলে নিজেদের মাঝমাঠ থেকে বলের নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করে, উভয়ের শক্তিই দারুণ গতিময় সব ফরোয়ার্ড। টুর্নামেন্টের সেই দুই সেরা দল এবার শিরোপায় হাত দিতে মহারণের অপেক্ষায়।

চট্টগ্রাম আবাহনী ও মালয়েশিয়ার তেরেঙ্গানু এফসির মধ্যকার রোমাঞ্চকর ফাইনাল দিয়ে বৃহস্পতিবার পর্দা নামার অপেক্ষায় শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপের তৃতীয় আসর। এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে ম্যাচ শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টায়।

নিজ নিজ গ্রুপ থেকে দুদলই সেমিফাইনালে উঠেছে সেরা হয়ে। নকআউটেও দুদলের খেলায় বয়েছে গোলবন্যা। প্রথম সেমিতে ভারতের ক্লাব শ্রী গোকুলম কেরালা এফসিকে ৩-২ গোলে হারিয়েছে টুর্নামেন্টের স্বাগতিক চট্টগ্রাম আবাহনী। পরের সেমিতে ভারতেরই আরেক ঐতিহ্যবাহী ক্লাব মোহনবাগানকে দাঁড়াতেই দেয়নি তেরেঙ্গানু। ব্রিটিশ অধিনায়ক লি টাকের হ্যাটট্রিকে হারিয়েছে ৪-২ গোলে।

দারুণ ফুটবল খেলে প্রত্যাশিতভাবেই ফাইনালে চট্টগ্রাম। স্বাগতিক দলের ফাইনাল দেখতে তাই টিকিটের জন্য হাহাকার। ৩০ হাজার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্টেডিয়ামের প্রতি কোণা যে ভরপুর থাকবে বলার অপেক্ষা রাখে না। এত দর্শকের সামনে চাপে পড়ে যাবে না তো স্বাগতিকরা?

এমন প্রশ্ন শুনেই কৌতুকের ছলে উত্তর দিলেন স্বাগতিক কোচ মারুফুল। হাসালেন সবাইকেই, ‘চাপ অবশ্যই আছে, ট্রফির ভারটা নিতে পারবো কিনা!’

হাসিয়ে পরের মুহূর্তেই নিজের চিরচেনা গম্ভীর চেহারায় ফিরে গেলেন মারুফ। নিজেদের ‘ফেভারিট’ দাবি করে বললেন নিজের কিংবা দলকে কোনো চাপে রাখতে চান না তিনি।

‘আমি নিজে সেভাবে কোনো চাপ নিচ্ছি না এবং আমার কাছে চাপ আসছেও না। আমার দলটার প্রতি আমার অনেক আত্মবিশ্বাস। হয়তো একটা ম্যাচে আমরা সেভাবে ভালো খেলিনি। কিন্তু প্রতি ম্যাচেই দলটা ক্রমান্বয়ে উন্নতি করছে। আগামীকালও করবে এবং আমার সেই আত্মবিশ্বাস আছে। যতটুকু চাপ আসবে তার সঙ্গে আমি সেই ২০০৮ থেকেই পরিচিত।’

একইভাবে কোনো চাপ না নিয়ে নিজের শিষ্যদের উপভোগ করার মন্ত্র দিচ্ছেন তেরেঙ্গানু কোচ নাফুজি বিন জেইন। নিজেদের ইতিহাসে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়ের এককদম দূরে থাকা দলটির কোচ বললেন, তারা ‘আন্ডারডগ’ হয়েই নামতে চান ফাইনালে।

‘আমি চাই আমার খেলোয়াড়রা খেলাটাকে উপভোগ করুক। আমার দল এখনো টুর্নামেন্টের আন্ডারডগ। ওরা (চট্টগ্রাম আবাহনী) টুর্নামেন্টের স্বাগতিক, নিজেদের দর্শকদের সামনে খেলবে। তারাই ফেভারিট। ওরা নিজেদের প্রস্তুত করার সময় পেয়েছে। আমি শুধু সামনেই তাকাতে চাই।’

চ. আবাহনী-তেরেঙ্গানু, দুদলই খেলে আক্রমণাত্মক ফুটবল। মাঝমাঠ থেকে বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উঠে যায় আক্রমণে। একই ধরন হলেও ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে স্পট-কিক। বিশেষ করে এই জায়গায় বেশ এগিয়ে তেরেঙ্গানু। দলটির অধিনায়ক লি টাক আছেন দারুণ ফর্মে। জীবনে প্রথমবার টানা দুই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছেন। দুই হ্যাটট্রিকের মধ্যে পাঁচটি গোল এসেছে স্পট-কিক থেকে।

গ্রুপপর্বে বসুন্ধরার বিপক্ষে শেষ ম্যাচে পেনাল্টি থেকে গোল করেছেন দুটি, মোহনবাগানের বিপক্ষে দুই ফ্রি-কিকে গোল আছে, আছে পেনাল্টি থেকেও। ফ্রি-কিক থেকে যে দুই গোল করেছেন, সেখানে দর্শক হয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না মোহনবাগান গোলরক্ষক দেবজিতের। বাংলাদেশের ফুটবলে এক মৌসুম খেলে যাওয়া ব্রিটিশ লি টাকের দিকেই তাকিয়ে থাকবে তেরেঙ্গানু। দলটির আক্রমণ শাণিত হয় তাকে ঘিরেই।

লি টাককে ‘উঁচু’ মানের ফুটবলার আখ্যা দিয়ে তাকে আটকাতে বিশেষ কৌশলও সাজিয়ে রেখেছেন মারুফুল। সেক্ষেত্রে তার তুরুপের তাস হতে পারেন হোল্ডিং মিডফিল্ডার মানিক হোসেন মোল্লা। জামাল ভূঁইয়া, আইভরি কোস্টের দিদিয়ে চার্লসও অভিজ্ঞ হোল্ডিং মিডফিল্ডার। তবে মানিক থাকায় দুজনই খেলতে পারছেন আক্রমণ ভাগে। যার ফলে নির্ভার হয়ে উপরে উঠে জামাল-দিদিয়ের দুজনেই রাখছেন গোল করা কিংবা বানিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অবদান।

সেখানে মানিকের কাজ হবে উপরিভাগে বলের যোগান দেয়া। একইসঙ্গে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ছয় গোল করা লি টাককেও অকার্যকর করে রাখা। তা করতে পারলে আক্রমণে বল পাবেন না ব্রুনো সুজুকি-শফিক বিন ইসমাঈলের মতো গতিময় ফরোয়ার্ডরা।

বল পায়ে না হয় লি টাককে আটকানো গেল, তার স্পট-কিক কি করে আটকাবেন মারুফ? সেক্ষেত্রেও কৌশল সাজিয়ে বসে আছেন চট্টগ্রাম কোচ, ‘ওদের একটা কম্বিনেশন আছে। ওদের নাম্বার ১৭(শফিক), ব্রুনো আর পেছন থেকে যখন লি টাক আক্রমণে যায়, তখন জায়গাটা ধরে রাখে হোল্ডিং মিডফিল্ডার রহমত বিন মাকাসুফ। এই কম্বিনেশনটা আমাদের ভাংতে হবে। এই জায়গাটা আমরা ধরে রাখতে পারলেই মনে হয় ওরা যেভাবে ফ্রি-কিক, পেনাল্টি আদায় করেছে সেটা আর সম্ভব হবে না।’

‘লি টাক মোহনবাগানের বিপক্ষে যে দুটি ফ্রি-কিক নিয়েছে, সেখানে মানব দেয়ালের দোষ ছিল। নইলে গোল হওয়ার কথা ছিল না। যদিও সে ভালো ফ্রি-কিক নেয়। কেউ যদি ভালো ফ্রি-কিক নেয় সেখানে গোলরক্ষকের কিছু করার থাকে না। লিওনেল মেসির ফ্রি-কিকও তো কেউ আটকাতে পারে না। ওকে আটকানোর জন্য অনেক বিশ্লেষণ করা হয়। এরপরও গোল হয়। আমরা এরপরও সতর্ক আছি।’

তেরেঙ্গানুর মতো চট্টগ্রামও আক্রমণে যায় চার ফুটবলারের সমন্বয়ে। নীচ থেকে জামালের সঙ্গে আক্রমণে উঠে যান দিদিয়ের, নীচে খেলেন চিনেদু ম্যাথিউ। এই তিনের কল্যাণে বল পান মন্টেনেগ্রোর ফরোয়ার্ড রতকোভিচ লুকা। তেরেঙ্গানু কোচের নজর এই চারের দিকেই। তাই গতানুগতিক ফুটবল এড়িয়ে বৈচিত্র্যময় খেলার কথা জানালেন মারুফুল।

কৌশল যেমনই হোক দারুণ এক ফাইনাল যে হবে সেব্যাপারে নিশ্চিত দুদলের কোচই। একদিকে চট্টগ্রামের চাওয়া প্রথম মৌসুমের মতো শিরোপাটা নিজেদের ঘরে রেখে দেয়া, অন্যদিকে উপভোগের মন্ত্র বিলানো তেরেঙ্গানুর স্বপ্ন দেশের বাইরে নিজেদের প্রথম শিরোপা জয়। দুদলের উপভোগ্য লড়াইয়ের ডাক এরইমধ্যে পৌঁছে গেছে চাটগাঁবাসীদের কাছেও। তাদের ভরপুর উপস্থিতিতে ম্যাচে যে-ই জয় পাক না কেনো, মাঠে ভালো খেলা হলে আদতে জয় হবে চট্টগ্রামের ফুটবলেরও।