গবেষণা এবং উন্নয়ন (Research and Development), সংক্ষেপে আর অ্যান্ড ডি (R &D) যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার ধারাবাহিক উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক এক বিভাগ। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানির আর অ্যান্ড ডি (R &D) বিভাগ যে কোনো মহামারী বা সংকটকালে নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে সংকট উত্তরণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। মেধার অদম্য চর্চা এবং প্রয়োগে উদ্ভাবিত হয় নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং কৌশল।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বিগত ৮-১০ বছর ধরে বিজ্ঞান গবেষণার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের অনুদানসহ প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা এবং উন্নয়নের জন্য প্রশাসনের তত্বাবধানে ‘গবেষণা এবং উন্নয়ন’ নামে স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে। লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য একটাই- নিজস্ব প্রযুক্তি উদ্ভাবন। কোভিড ১৯ প্রাদুর্ভাবের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং বহুজাতিক কোম্পানির গবেষকরা কোভিড ১৯ রোগ নির্ণয় এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য হাজারো রকমের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। অথচ বিজ্ঞান গবেষণায় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর শত প্রণোদনার পরেও এই সংকটকালে আমরা কোনো নিজস্ব প্রযুক্তি পেলাম না। আবার অন্যদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারেও আমাদের সক্ষমতা সীমিত। অথচ বর্তমান সংকটে- গণস্বাস্থ্যই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যারা অন্তত একটি প্রযুক্তি বা কৌশল (GR COVID-19 Rapid Antibody Dot test) উদ্ভাবনের সক্ষমতা দেখিয়েছে। কতটুকু উপযোগী, এখনেও অজানা। তথাপি- দেশীয় প্রযুক্তি। এখানে তাদের মেধা, শ্রম এবং সময়ের সাথে একটি অদম্য প্রতিযোগী মনোভাবও বিনিয়োগ করা আছে। গবেষকরা সৃষ্টির সাফল্য দেখতে ত্বরিত সিদ্ধান্ত চাইতেই পারে? অথচ- প্রায় দুইমাস যাবত বিতর্ক চলছে।
কেন এই বিতর্ক? দেশে একটা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা, ওষুধ প্রশাসন থাকতে আমরা কেনো পক্ষে বিপক্ষে বিতর্কে জড়াচ্ছি? তাহলে নিয়ন্ত্রন সংস্থার সক্ষমতা কি প্রশ্নবিদ্ধ?
মূলত কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন নিয়েই বিতর্ক চলছে। যেমন-
১। এই র্যাপিড টেস্ট কিটের প্রয়োজনীয়তা কি আছে? অবশ্যই আছে, হয়তো এই মুহূর্তে নয়। আমাদের দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি (CDC)-র মতন সমকক্ষ কোনো প্রতিষ্ঠান এই ধরনের কিট ব্যবহারের সঠিক সময় নির্ধারণ করবে। সেই সঠিক সময়ের জন্য এই ধরনের টেস্ট কিটের পর্যাপ্ত সরবরাহের পরিকল্পনা এখনই নেওয়া উচিত।
২। ওষুধ প্রশাসনের সক্ষমতা? বিভিন্ন দেশে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেশের বিশিষ্ট গবেষক/চিকিৎসকরা জড়িত থাকে। বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে শক্তিশালী কাউন্সিল থাকেন। বিশেষ প্রয়োজনে ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সক্ষমতা রাখেন। কাউন্সিলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকে না।
৩। CRO (Contract Research Organization) ওষুধ প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত নিরপেক্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এই সকল প্রতিষ্ঠান দ্বারা কার্যকারিতা পুনঃমুল্যায়ন করে অনুমতির জন্য আবেদন করতে হয়। গণস্বাস্থ্য সম্ভবত এই নিয়মের ব্যত্যয় চেয়েছিল। তবে এই ধরনের কিটের ক্ষেত্রে শিথিলতার সুযোগ থাকতেও পারে? বর্তমানে অনেক নির্ণীত কোভিড ১৯ রোগী থাকায় অল্প সময়ের মধ্যেই পুনঃমুল্যায়ন সম্ভব।
৪। নৈতিকতার প্রশ্ন? এইরকম একটা সংকটময় সময়ে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে এন্টিবডি সংগ্রহ অত্যন্ত দুরূহ কাজ। বন্ধুভাবাপন্ন প্রতিষ্ঠান বা গবেষকরা সাধারণত নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের নিয়মের মধ্যে এই ধরনের বিনিময় করে থাকেন। এই ধরণের বিনিময়ের ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন কি আছে? থাকা উচিত নয়। আমাদের দেশের কত গবেষকদের মাধ্যমে আমার আপনার হাজার হাজার নমুনা এবং তথ্য বিদেশে চলে যাচ্ছে- আমরা কেউ কি খবর রাখি বা জানি? ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে এতদবসংক্রান্ত প্রশ্ন উঠানো মানে- টেলিভিশন বিতর্কের মতন, বিতর্কে আমি প্রস্তাবনার বিপক্ষে বক্তব্য রাখছি। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটা যুতসই যুক্তি খাড়া করানো।
৫ । কার্যকারিতা এবং মূল্যায়ন? কিটের কার্যকারিতা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক হবে। যারা নিজস্ব প্রুযুক্তি নিয়ে এতো বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, আমি নিশ্চিত তারা জয়ী না হয়েই পারে না। গবেষণায় শুধু অর্থই বিনিয়োগ হয় না। এখানে মেধা, শ্রম এবং সময়ের সাথে একটি অদম্য প্রতিযোগী মনোভাবও বিনিয়োগ করা হয়। মেধাস্বত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্বের জন্য গবেষণাকর্ম অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। তাই বিলম্বিত সিদ্ধান্তে মেধা, শ্রম এবং সময়ের অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গবেষকরাই যথাযথভাবে এই গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন। সেহেতু, গবেষক এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের কাজের মূল্যায়ন সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের দ্বারাই মুল্যায়িত এবং নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। অন্যথায় সকল প্রাপ্য বিলম্বিত হতে পারে, এমনকি অপ্রয়োজনীয়ও হয়ে উঠতে পারে।
ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন সমাজসেবক। পেশাদার চিকিৎসক বা গবেষক নন। সেহেতু বিভিন্ন টকশোতে সাঁড়াশি আক্রমনে বিপন্নবোধ করেছেন। দেখে আমরা অনেকেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছি। সঞ্চালক এবং সাংবাদিকরাও দর্শক-নন্দিত অনুষ্ঠানের কৃতিত্ব উপভোগ করেছেন। ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে যখন টকশো-তে রাস্তার ওষুধ বিক্রেতার সাথে তুলনা করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন, তখন সত্যিই আমরা বিব্রতবোধ করি। ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভুলভ্রান্তি থাকতেই পারে। সমসাময়িক বিজ্ঞান বিষয়ে অনেক কিছু নাও জানতে পারেন। কিন্তু অনেক আশাবাদী একজন মানুষ। অনেকটা অদম্য এবং ক্ষ্যাপা। ৭১-এ কতিপয় সাহসী লোকের মতন এই ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন আমাদের কাছে স্বপ্নের মানুষ, বাংলাদেশের প্রতিকৃতি। ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আপনার বিপক্ষে সঞ্চালকরা তুখোড় তুখোড় বিতার্কিক জড়ো করেছেন- সফল প্রতিদ্ধন্দতার জন্য, জয়ী হয়ার জন্য। কিন্তু আপনার প্রযুক্তির কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী সংগ্রহ করতে পারেনি। আপনাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আপনাকে এবং আপনার প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)