বন্দর নগরী চট্টগ্রামের অবস্থান দেশে রাজধানীর ঢাকার পরই। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমের সাথে তাল মিলিয়ে এ শহরকে উন্নতকরণের প্রকল্পগুলো স্থবির হয়ে আছে দিনের পর দিন। কচ্ছপের গতিতে চলছে কাজ। জনজীবনে রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সবই দুর্বিষহ। প্রতিদিন এখানকার মানুষ দিনের বেশীর ভাগ সময় ডুবে থাকে জোয়ার ভাটার কারণে জলাবদ্ধতার পানির নীচে। কিন্তু এসব নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত কথা বলার মত তেমন কোন সুযোগ নাই এখানকার সাধারণ জনগণসহ সুধী সমাজের। কারণ চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক বা নগর ভিত্তিক মিডিয়া এদেশে নেই।
ঠিক যেমন করে জোয়ার ভাটার পানিতে ডুবে দিশাহারা চট্টগ্রামের মানুষ। তেমনিভাবে তাদের যাপিত জীবনের হাজারো খবর চাপা পড়ে থাকে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে চট্টগ্রামের সব খবর স্থান পায় না, প্রধান প্রধান কিছু খবর ছাড়া অন্য আর কিছু ।
মূলত বাংলাদেশের সব সেক্টরই গড়ে উঠেছে ঢাকা নগর কেন্দ্রিক। তবে দেশের নগরায়নকে সম্প্রসারিত করতে হলে ব্যবসা বাণিজ্যর পাশাপাশি গন মাধ্যমের ভূমিকা বাড়াতে হবে অবশ্যই। আর সেজন্য মিডিয়াতে নগর ভিত্তিক খবরাখবর প্রকাশ ও প্রচারের সুযোগ তৈরি করতে হবে। এটা ক্রমান্বয়ে সকল নগরের জন্য হতে হবে।
চট্টগ্রাম দেশের দ্বিতীয় নগর এবং এর কিছু বিশেষত্ব আছে বলে এখানে সম্ভাবনার সফলতা আগে আসবে।
দেশের প্রধান প্রধান পত্রিকার পাতায় চট্টগ্রামের জন্য একটা নিয়মিত পাতা নেই বললে চলে। স্থানীয় পত্রিকা হিসাবে দৈনিক আজাদী, পূর্বকোণ সহ ৩/৪টি পত্রিকা রয়েছে। কিন্তু এ পত্রিকাগুলো দিয়ে সারাদেশের মানুষ জানতে পারে না এখানকার খবর। বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলোর যে গণমাধ্যম কর্মীরা এ শহর কাজ করে তারাও অনেকটা হতাশ। কারণ বিশেষ বিশেষ খবর ছাড়া তারা এখানকার সব খবর মানুষকে জানাতে পারে না। এদিকে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষদের মাঝে এ নিয়ে ক্ষোভ আক্ষেপ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। ঢাকা শহরের মত এখনকার জনজীবনের সমস্যাগুলো মুহূর্তে জানাবার মত কোন সুবিধা তাদের কাছে নেই।
এর চেয়েও বড় বিষয় হল বর্তমানে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া কর্মসংস্থান জন্য বড় একটি ফ্যাক্টর। কিন্তু এ বন্দর নগরীতে যারা সাংবাদিকতা এবং সাংস্কৃতিক জগতকে পেশা হিসাবে নিতে চায়, তাদের জন্য কাজের সুযোগ নাই। ফলে অন্য সবার মত তারাও ছুটে ঢাকার দিকে।
কিন্তু রাজধানীমুখী মানুষের স্রোতের গতি পরির্বতন করতে হলে অন্যান্য নগরগুলোকে সবভাবে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করতে হবে সকল সেক্টরে। সে ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও একটি। এখানকার গণমাধ্যম কর্মীদের কাজের সুযোগ করে দিতে এগিয়ে আসতে হবে ঢাকা ভিত্তিক মিডিয়া ব্যবসায়ীদের। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে স্বল্প পরিসরে নগরের খবর হিসেবে চট্টগ্রামকে দেখলে এ জনপদের অনেক কিছু অবহেলিত রয়ে যাবে। যা এখন সরকারি বেসরকারিভাবে ভাবার সময় এসেছে।
অনেক ক্ষেত্রে মিডিয়াতে মালিক পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন সংকটের কথা উঠে আসে। বোধ করি বর্তমান সময়ে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের সাথে বিজ্ঞাপন সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব কিছু সুচিন্তিত পদক্ষেপে নিলে। সেক্ষেত্রে যদি খবরের পাতায় চট্টগ্রামের সকল ধরনের সংবাদসহ নানাবিধ বিষয় প্রতিনিয়ত প্রাধান্য পায় তাহলে এখানকার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহ দেখাবে বিজ্ঞাপনের বিষয়ে।
বর্তমানে দেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে প্রায় ১৫/১৬টি চ্যানেল চালু রয়েছে। আরও কিছু চ্যানেল আসার অপেক্ষায়। সম্প্রচারিত চ্যানেল গুলোতে বিনোদনমুলক অনুষ্ঠান, নাটক গান টক শো সবই হয় ঢাকা ভিত্তিক। কোন একটি চ্যানেলে নগর ভিত্তিক অনুষ্ঠান প্রচার করে না। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশনের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ছাড়া আর কোন চ্যানেলে চট্টগ্রামের জন্য প্রতিদিন কোন সম্প্রচার নাই। কিন্তু এ অঞ্চলের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির একটা বিশেষত্ব রয়েছে। এছাড়া রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। সুফি সাধক মরমী গানের অনেক জানা অজানা ঐতিহ্য আছে এখানে। পর্যটনের স্থান বলতে গেলেই প্রথমে আসে চট্টগ্রামের নাম। এখানকার সব কিছু সারা দেশের এমনকি বিদেশীদের আকর্ষণীয়। কিন্তু এখান থেকে অনুষ্ঠান তৈরি করে প্রচারের সুযোগ নেই বললে চলে।
সাধারণত দেখা যায় একই দেশের মানুষ হলেও অঞ্চল ভেদে সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্প জগতকে কেন্দ্র করে যারা বেড়ে উঠে তাদের মাঝে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে। চট্টগ্রামের বেলাতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। যার ফলে এখানকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মানুষরা তাদের মত করে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ না পেয়ে জীবিকার তাগিদে খুঁজে নেয় অন্য কোন পথ। আর অনেকেই সুযোগের আশায় ছুটে যায় ঢাকাতে। এতে করে নিজের চেনা জানা জায়গা থেকে কাজের পরিবেশ আর পায় না। নিজের সংস্কৃতি ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে যায় সময়ের ব্যবধানে জীবনের স্রোতে । চট্টগ্রামের সংস্কৃতি পিয়াসি মনের এমন সুধী-জনদের প্রতিভা বিকাশের আশ্রয়স্থল বলতে আছে ক্ষুদ্র পরিসরে বাংলাদেশ টেলিভিশনের চট্টগ্রাম কেন্দ্র আর শিল্পকলা। কিন্তু স্যাটালাইটের যুগে এ দুটি মাধ্যমে এখানকার সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রতিভা বিকাশের তেমন কোন আশার স্থান নয়, এটাই বাস্তবতা ।
এর পাশাপাশি বিশেষভাবে উল্লেখিত, পাশের দেশ ভারতের মত আমাদের বিশাল মিডিয়া বাজার নেই। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের দেশে ১৬/১৭টা চ্যানেল চলছে শুধুমাত্র ঢাকা কেন্দ্রিক হয়ে। এরপরে বিষ ফোঁড়ার মত যে বিষয়টা কাজ করে তাহলো ভারতীয় সিরিয়াল।
এ অবস্থায় মিডিয়া ব্যবসায়ীদের একবার ভেবে দেখা উচিত ভারত যদি তাদের অঞ্চল ভিত্তিক মিডিয়াগুলো দিয়ে শুধু নিজেদের দেশ নয়, আমাদের দেশের জনগণকে ও আকর্ষিত করছে তাদের আচার আচরণ ধ্যান ধারনা দিয়ে। সেখানে আমরা কেন আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক চিন্তা চেতনা দিয়ে নগর ভিত্তিক মিডিয়ার প্রসার ঘটাতে পারব না?
ভিন দেশী মিডিয়ার আগ্রাসনে আগামী প্রজন্ম নিজেদের শেকড়ের আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলছে।
অনেক বড় পরিসরে না হোক ছোট পরিসরে চট্টগ্রামের সংবাদ সাংস্কৃতিক জগতের কার্যক্রম এ শহর ভিত্তিক করে গড়ে তুললে দেশের মানুষ জানতে পারবে এ অঞ্চলকে। ঢাকামুখী নগরায়ন মানুষের ভাবনাতে আরেকটি শহর নিয়ে চিন্তার জগত তৈরি হবে।
কথায় আছে ‘ প্রচারেই প্রসার’। সুতরাং গণমাধ্যমে চট্টগ্রামের আলাদা অবস্থান হলে এটা হবে এ অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প,সংবাদ, সাহিত্য- সাংস্কৃতিক জগতের উন্নয়নের নতুন দুয়ার উন্মোচন। তবে এর জন্য মিডিয়া ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। কারণ বাংলাদেশের মিডিয়া এখন বেসরকারি ভাবে বাণিজ্যিক রূপে প্রতিষ্ঠিত। দেশে নগরায়ন গণমাধ্যমের সূচনা ঘটুক সে সাথে খবরের পাতায় কিংবা টিভি চ্যানেল চট্টগ্রাম অবহেলিত এ অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে এমন প্রত্যাশা আগামী দিনের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)