চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

গণতন্ত্রীরাই গণতন্ত্রবিরোধী!

গণতন্ত্রের দোহাই দিয়েই গড়ে ওঠে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন। বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে, সেমিনারে, টকশোতে, পথসভায় ও জনসভায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বক্তৃতা চলে। শব্দ বিপ্লবীর ভূমিকায় নামা এইসব নেতৃবর্গ যারা গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করতে করতে মুখে ফেনা ওঠান তারা নিজেরা নিজেদের নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে কতোটা গণতন্ত্রী

এ বিষয়ে কিছু বাস্তবতা উপস্থাপন যোগ্য। প্রথমেই বিভিন্ন দলের দলীয় মনোনয়নের কথা বলা যায়। সংসদ নির্বাচন হতে শুরু করে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়নগুলোতে দলীয় অভ্যন্তরে মনোনয়ন দৌঁড়ের তুমুল প্রতিযোগিতা দেখা যায়। মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়ে অনেক দলীয় নেতাকে দেখা যায় দলীয় মনোনয়ন অমান্য করে ভিন্ন দলকে সমর্থন দিতে এক্ষেত্রে তাদের মানসিক অবস্থাটা এরকম থাকে, যেহেতু আমাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি দেখি কিভাবে পাশ করে।

দলীয় প্রতীককে ফেল করিয়ে প্রতিপক্ষ দলকে জিতাতে পারাতেই বুঝি তার মানসিক জয়! দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেও এরকম চিত্র। দেখা গেল, কেন্দ্রীয় কমিটি ও কাউন্সিলরদের ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচন হল। যে নেতা হেরে গেল সে নেতা তখন নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলবেন। আবার এই নেতা যদি পাশ করতেন তখন নির্বাচন পদ্ধতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠতেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম, ডান ও ইসলামপন্থী সহ সকল দলের নেতাদেরই এই চিত্র।

মুখে সবাই গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চেঁচাবে কিন্তু নিজের বিরুদ্ধে গেলেই ভিন্ন সুর। যেমন গণতন্ত্রী সংগঠনের সম্মেলন চিত্রে দেখা যায় রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় ব্যালটের মাধ্যমে। ভোটার হয় কেন্দ্রীয় সাবজেক্ট কমিটি ও জেলার কাউন্সিলরবৃন্দ। সকলে গোপন ব্যালটে ভোট প্রদান করে। ভোট কার্যক্রম পরিচালিত হয় সংগঠন কর্তৃক মনোনীত নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে। ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেল এই বলে শ্লোগান দিতে, স্বৈরাচারী কমিটি মানিনা, মানি না।

এক কথায়, বিচারের রায় মানি তবে তালগাছটা আমার ভাগে পড়তে হবে। এই হলো গণতন্ত্রের ঠোঁটস্থ চর্বিত চর্বনকারী গণতন্ত্রী নেতাদের অবস্থা। যে দল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করবে কিন্তু দলগত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেনা সে দল গণতন্ত্রের জন্য কতটা যোগ্য? দলের নেতৃত্ব নিয়ে এত উপদল কেন? দল ভেঙে নতুন দল গড়ে কেন? বাম, ডান, মধ্য ও ইসলাম পন্থী সকল দলই ভাঙে। সবাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বক্তৃতায় সিদ্ধকন্ঠ। নিজেদের হাত পা নাড়ানো, জীবনযাপন ও আচরণবিধিতে গণতন্ত্রের ধারে কাছেও নেই।

সবারই মূল টার্গেট তাল গাছ, গণতন্ত্র নয়। যেসব দল দলের নেতৃত্ব নির্বাচন ও শৃঙ্খলা রক্ষায় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি পালনে ব্যর্থ হয়। যেসব দলে গ্রুপবাদ চর্চা ও দল ভেঙ্গে নতুন দল সষ্টিতে সহায়ক হয় সে সব দলের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা কতটা যৌক্তিক?

অথচ দুর্ভাগা জাতিকে তা-ই দেখতে হচ্ছে। এখানে গণতন্ত্র প্রতিনিয়ত পরাজিত হচ্ছে নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও উপদলীয় আধিপত্যবাদের কাছে। গণতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতার খোলসে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে প্রকৃত গণতন্ত্র। সবাই গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিচ্ছে নিজেদের তালগাছের দিকে চেয়ে। বিএনপি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছে আবার পেট্রোল বোমা মেরে গণমানুষ হত্যাও করেছে। একসময়ের গণতন্ত্র হত্যাকারী স্বৈরাচার এরশাদও গণতন্ত্রের কথা বলছে।

৯০ এ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকারী ও এরশাদ পন্থীদের কন্ঠ একাকার হয়ে গেছে। গণতন্ত্রের রায় অমান্যকারী বাংলাদেশ বিরোধী পাকিস্তান পন্থী আলবদর রাজাকাররাও বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে গণতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে। আওয়ামী লীগ শাসনদণ্ড হাতে বিভিন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাকেন্দ্রিক পেশিশক্তি ব্যবহারও করছে আবার গণতন্ত্রের কথাও বলছে।

বামপন্থী দলগুলো কেউ সরকারকে সমর্থন দিয়ে গণতন্ত্রের কথা বলছে কেউ সরকারকে অগণতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে গণতন্ত্রের কথা বলছে। ১৪ দলীয় জোটের শরীক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। একই সংসদ ও একই রাজনৈতিক জোটে থাকা স্বত্বেও অপর শরীকের বিরুদ্ধে প্রায়ই নির্বাচনকেন্দ্রিক অগণতান্ত্রিক আচরণের অভিযোগ আনতেও দেখা যায়।

নিজ দলেই অগণতান্ত্রিকতা ও স্বেচ্ছারিতার অভিযোগ এনে জাসদ (ইনু)র একাংশ জাসদ (আম্বিয়া-প্রধান) গঠন করল। সাম্যবাদী দলের একাংশকে স্বেচ্ছারিতার অভিযোগ এনে দীলিপ বড়ুয়া হতে আলাদা হয়ে যেতে দেখেছি। জাসদ ভেঙ্গে বাসদ ও পরবর্তিতে এক বাসদ ভেঙ্গে ৪/৫টি বাসদ হতে দেখেছি। অতীতে আওয়ামী লীগ (মালেক) ও আওয়ামী লীগ (মিজান) দেখেছি। বিএনপি (খালেদা) বিএনপি (ওবায়েদ) দেখেছি।

খালেদা-ওবায়েদ দ্বন্দ্বে ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও বিভক্ত হয়ে পড়ে খালেদাপন্থী ছাত্রদল ও ওবায়েদপন্থী ছাত্রদল হিসাবে। সেই বিভাজন এখনও আছে। ওবায়েদুর রহমানের স্ত্রী শাহেদা ওবায়েদ আসল বিএনপি দাবীদার হয়ে এখনও সাংগঠনিক তৎপরতা চালু রেখেছেন। ওয়ার্কার্স পার্টির বন্ধু ছাত্র সংগঠনের কাউন্সিলে দু’জন করে সভাপতি সম্পাদক হলো।

মাসের পর মাস পেরিয়ে যাচ্ছে জটিলতা কাটছে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সুষ্ঠুভাবে কেন নেতৃত্ব নির্বাচন হতে পারলো না? গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা ছাত্রমৈত্রীতেও হয়তো গণতান্ত্রিক রীতিপদ্ধতি জানার ও মানার অভাব রয়েছে, বিষয়টা তা নয় কি? গণতন্ত্র সংগঠনের কর্মীদের চেতনার রক্তমাংসে মিশতে পারছে না । তাই দলের কাউন্সিলে প্রত্যাশিত নেতৃত্বের পদ পদবী না পেলে অনেককেই সাংগঠনিক কর্মসূচী হতে দূরে সরে থাকতে দেখা যায়। গণতন্ত্রের উদার জমিনে এক অনুদার, অদ্ভুত আঁধার গ্রাস করে রেখেছে সর্বত্র। এ-থেকে মুক্তির সম্ভাবনাও প্রশ্নবিদ্ধ।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)