চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

গণকর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ ও অন্যান্য তর্ক

আমাদের গণকর্মচারীরা (পাবলিক সার্ভেন্ট, যারা নিজেদের কর্মকর্তা বলে দাবি করেন) নানা ছুতোয় বিদেশ যেতে খুবই আগ্রহী। বিশেষ করে সিনিয়র কর্মচারীরা।

বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেমিনারে দেখা গেছে, সচিব, যুগ্ম সচিব বা এরকম পদ মর্যাদার অনেকে অংশগ্রহণের জন্য যান। কিন্তু পুরো অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি কথাও বলেন না। শুধু মনোযোগ দিয়ে অন্যের আলোচনা শোনেন। সেমিনার শেষ হলে শপিংয়ে যান। এত বড় সেমিনারে এলেন অথচ কিছু বলেন না। এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা দেখা গেছে, যিনি ওই সেমিনারে গিয়েছেন, তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনারে বলার মতো কিছুই জানেন না। হয়তো কিছুদিন আগেই তিনি এই মন্ত্রণালয় বা দপ্তরে এসেছেন। কিন্তু সরকার তাকে পাঠিয়েছে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে। জনগণের অর্থে এসব সরকারি সফরে দেশের কোনো লাভ না হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য এটি একধরনের আনন্দ ভ্রমণের উপলক্ষ্য তৈরি করে এবং তাদের ঘরে বিদেশি জিনিসপত্রের পরিমাণ বাড়াতে সহায়তা করে।

এটি গেলো সরকারি কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণের একটি দিক। আরেকটি দিক হলো, তাদের অনেকেই এমন সব বিষয়ে এমন সব দেশে ‘জ্ঞান অর্জনের’জন্য যান, যা হাস্যরসের জন্ম দেয়। সর্বশেষ এরকম একটি খবর গণমাধ্যমে এলে তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

আফ্রিকার দেশ উগান্ডার বেশির ভাগ মানুষ নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত। সেখানে উন্নত পয়োনিষ্কাশন সুবিধারও অভাব। অথচ চট্টগ্রাম ওয়াসা তাদের ২৭ জন কর্মকর্তা–কর্মচারীকে ‘প্রশিক্ষণের’ জন্য পূর্ব–মধ্য আফ্রিকার এই দরিদ্র দেশে পাঠিয়েছে। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের আরও ১৪ জন কর্মকর্তাও দেশটি ভ্রমণে গেছেন। বলা হচ্ছে, এই সফরে ব্যয় হয়েছে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে এ ব্যয় বিশ্বব্যাংক বহন করলেও পরে সুদে-আসলে তা ওয়াসাকেই পরিশোধ করতে হবে।

এই খবরের রেশ না কাটতেই মশাবাহিত সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সিঙ্গাপুরে গেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। গত ৮ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন তিনি।

এর আগে পুকুর খনন ও ক্ষুদ্র সেচের দক্ষতা লাভের জন্য সরকারি কর্মচারীদের বিদেশ সফরও আলোচনায় এসেছে। বস্তুত প্রকল্প মানেই তার সঙ্গে বিদেশ সফর রাখার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, সেখানে মূলত উদ্দেশ্য থাকে প্রমোদ ভ্রমণ।

অথচ তারা যেসব বিষয়ে কথিত জ্ঞান অর্জনের জন্য বিদেশে যান, সেসব জ্ঞান দেশের বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, এখন ইন্টারনেটে সার্চ দিয়েও অনেক তথ্য জানা যায়। সুতরাং নদী ও পানির দেশের কর্মচারীরা পুকুর খনন শেখার জন্য বিদেশে গিয়ে আসলে কী জ্ঞান অর্জন করেন তা বলাই বাহুল্য।

অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, যিনি যে বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জনের জন্য ট্যুরে যান, হয়তো সে বিষয়ে তার প্রাথমিক ধারণাই দুর্বল। আবার ফিরে এসে তিনি যে সেই জ্ঞান তার বিভাগে কাজে লাগান, তারও উদাহরণ কম। সর্বশেষ বিতর্ক উঠলো যে চট্টগ্রাম ওয়াসারা কর্মকর্তাদের উগান্ডা সফর নিয়ে, তার যুক্তিতে বলা হয়েছে, তারা সেখানে গিয়েছেন কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট শিখতে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বিবিএ-এমবিএ’র মতো বিষয় পড়েন, সেখানে কী কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট শেখানো হয় না? না হলে বাংলাদেশের চেয়ে আর্থ-সামাজিকভাবে দুর্বল একটি দেশে গিয়ে তাদের কেন এ বিষয়টি শিখতে হচ্ছে? আর ধরে নেয়াই গেলো যে, উগান্ডার কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট বাংলাদেশের চেয়ে ভালো, তো সেই ভালোর কী প্রয়োগ ওয়াসার কর্মকর্তারা চট্টগ্রামের প্রয়োগ করলেন এবং তার ফলে কী গুণগত পরিবর্তন এসেছে, সেটিও জানার অধিকার জনগণের আছে।

তবে গণকর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণের এই ইস্যুটিকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বলে ভাবলে ভুল হবে। বরং এটি রাষ্ট্রের সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার যে সংকট, তারই বাইপ্রোডাক্ট। যে প্রোডাক্টের মধ্যে আছে রেলের প্রকল্পে পিয়নের বেতন চার লাখ টাকা কিংবা ফটোকপি মেশিন অপারেটরের বেতন ৮৩ হাজার টাকা ধরা; যে প্রোডাক্টের মধ্যে আছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বালিশ কেনা ও ওঠানোর অবিশ্বাস্য খরচ; ফরিদপুর মেডিকেলে ৩৭ লাখ টাকা মূল্যের পর্দা, ১ লাখ ১২ হাজার টাকায় স্টেথোস্কোপ, ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ভ্যাকিউম প্ল্যান্ট কেনা।

রেলের প্রকল্পে অস্বাভাবিক বেতন ধরার বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় এখন এর সমালোচনা হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনও বলছে যে এটি অবাস্তব। কিন্তু প্রশ্ন হলো যারা এই প্রকল্প তৈরি করলেন, তারা কী খেয়ে এটা বানিয়েছেন? তাদের মনে কি এরকম প্রশ্ন তৈরি হয়নি যে, বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বা ধরা পড়লে এটা আটকে যাবে? নাকি তারা মনে করেছিলেন যে, কোথাও যেহেতু কোনো জবাবদিহিতা নেই বা যেকোনো কিছু করেই যেহেতু পার পাওয়া যায়, সুতরাং এটিও হয়তো পার পেয়ে যাবে। যারা পর্দা ও বালিশকাণ্ড ঘটালেন, তাদের মনে কি একবারও এই ভয় তৈরি হয়নি যে, বিষয়টি জানাজানি হয়ে যেতে পারে? নাকি তারা ধরেই নিয়েছিলেন এবং নিশ্চিত ছিলেন যে, যেহেতু কোথাও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বালাই নেই, অতএব তাদের উপরমলই তাদের রক্ষা করবেন?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)